ভোজ্যতেলের দামবৃদ্ধি নিয়ে সরকার–ব্যবসায়ী মুখোমুখি, কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিদ্ধান্ত আজ
কোনো ঘোষণা ছাড়াই ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে সরকার ও ভোজ্যতেল আমদানিকারক–বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকার জানিয়েছে, এই মূল্যবৃদ্ধি অনুমোদিত নয় এবং তা অবৈধ।
চলতি সপ্তাহে হঠাৎ করেই রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পুরনো দামের চেয়ে লিটারে ৯ টাকা বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রূপচাঁদা, তীর, পুষ্টি, ফ্রেশসহ প্রায় সব ব্র্যান্ডের তেল বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে বাজারে আসা পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৯৮ টাকা—যেখানে আগে তা ছিল ১৮৯ টাকা। তবে এক ও দুই লিটারের নতুন দরের বোতলের সরবরাহ এখনো পর্যাপ্ত নয়।
সরকার বলছে, কোম্পানিগুলো নিয়ম বহির্ভূতভাবে দাম বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আজ বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে বৈঠকও ডাকা হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেন, "তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকার কিছু জানত না। আজই জেনেছি। কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে এ কাজ করেছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।"
এ পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করব। এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।"
মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে কীভাবে দাম বাড়ানো হলো—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "সেটা কোম্পানিগুলোই বলতে পারবে। আমরা ব্যবস্থা নেব। আলোচনায় বসেছি। এর আগেও তারা দাম বাড়াতে চেয়েছিল, অনুমোদন না থাকায় পারেনি। আইন লঙ্ঘন হলে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"
রিফাইনারি বন্ধ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে
অনুমতি ছাড়া দাম বাড়ানোর শাস্তি হিসেবে কোম্পানিগুলোর রিফাইনারি বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে বলে মত দিয়েছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এএইচএম সফিকুজ্জামান।
বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোম্পানিগুলো সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বাজারে বাড়তি দামের তেল ছাড়ছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে—জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এবং কেন অনুমতি ছাড়া দাম বাড়ানো হয়েছে, সে বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে ডেকে জানতে চাওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টন সয়াবিন তেল বিক্রি হয়। লিটারে ৯ টাকা বাড়ালে একদিনেই ভোক্তার কাছ থেকে বিপুল অর্থ নেওয়া যায় তবে এখনো সব বাজারে বাড়তি দামের তেল পৌঁছায়নি। এখনই এই বাড়তি দামের তেল বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে হবে।"
নিয়ম মেনেই দাম বাড়ানো হয়েছে দাবি রিফাইনারদের
এদিকে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, আইন মেনেই তারা দাম বাড়িয়েছে।
সংগঠনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মল্লা বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও বাড়াতে হয়, কমলে কমাতে হয়—এটা কারও ইচ্ছার বিষয় না। বিশ্ববাজারের খবর সবারই জানা।"
তিনি আরও দাবি করেন, "আমরা ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ব্যাংক—সবার সঙ্গেই আলোচনা করে দাম বাড়িয়েছি। ইচ্ছে করলেই কেউ ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে পারে না।"
তিনি আরও বলেন, "ঋণপত্র (এলসি) খুলে যে তেল আনা হচ্ছে, তার দামের সঙ্গে সমন্বয় না হলে লোকসান হবে, ভবিষ্যতে বুকিং সম্ভব হবে না। ১৫ দিন বা এক মাস পরপর দাম সমন্বয় করলে বাড়তি চাপ পড়ে না—তখন দু–তিন টাকা করে বাড়ে। গত দু–তিন মাস কোনো সমন্বয় ছিল না বলেই এবার দাম বেশি বেড়েছে গত আগস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম কমলে আমরা ১৯ টাকা কমিয়েছিলাম।"
মেঘনা গ্রুপের জিএম তাসলিম হোসেন বলেন, "বিধি অনুযায়ী তিন মাস অন্তর দাম সমন্বয় হওয়ার কথা। আগস্টে দাম কমেছে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, কিন্তু সরকার বাড়াতে দেয়নি। বৃহস্পতিবার সরকার আমাদের ডেকেছে। বেশি দামে না বিক্রি করলে লোকসান হবে।"
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ নভেম্বর দাম বাড়ানোর আবেদন করে, যা ২৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর করার কথা জানায়। সমিতির নতুন প্রস্তাবে বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার ১৯৯ টাকা, পাঁচ লিটার ৯৮৫ টাকা, খোলা সয়াবিন লিটার ১৭৯ টাকা এবং পাম অয়েল লিটার ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে যা বলা আছে
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল অব অ্যাসেনসিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট–১৯৫৬ অনুযায়ী ২০১১ সালে জারি করা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ–২০১১–তে বলা আছে—উৎপাদক, পরিশোধক বা আমদানিকারক অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়াতে, কমাতে বা পুনর্নির্ধারণ করতে চাইলে ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে করতে হবে এবং কমপক্ষে ১৫ দিন আগে মনিটরিং সেল, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাতে হবে।
ব্যবসায়ীদের দাবি—তারা এই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করেছেন।
২০২১ সালের জুনে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের সমন্বয় করতে একটি সরকারি কমিটি গঠন হয়, যেখানে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
সর্বশেষ আগস্টে কমিশনের সুপারিশে দাম কমানো হয়। তবে এর পরপরই কোম্পানিগুলো আবার সরকারকে না জানিয়ে অক্টোবরেও দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে—তখন বাণিজ্য উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ব্যবসায়ীরা পিছু হটে।
