কড়াইল বস্তির বাসিন্দাদের রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে, কী আছে জয়নব-জাকিয়াদের ভাগ্যে?
মাত্র ৯ মাস বয়সী ছোট্ট শিশু মেহরিমা। দু'চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের মেঝেতে। গায়ের নিচে খুবই পাতলা একটি চাদর বিছানো। আর মাথার ওপরে খোলা আকাশ। পাশে বসে মশা তাড়ানোর জন্য বাতাসা করছিলেন তার বাবা আব্দুল মমিন।
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়েছে আব্দুল মমিনের ঘরের সকল আসবাবপত্র। নিরাপত্তার কারণে বন্ধ বস্তির বিদুৎ সংযোগও। স্ত্রী গিয়েছেন একটি মোমবাতির খোঁজে। তাই আবছা অন্ধকারে সন্তানকে আগলে বসে আছেন তিনি।
আব্দুল মমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'অল্প বেতনের একটা চাকরি করি। বস্তির একটা ঘরে বউ-বাচ্চা নিয়ে বসবাস করতাম। আগুনে সবকিছু পুড়ে শেষ। এই ঘরের মেঝেতেই কোনোমতে রাত পার করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, '৯ মাস বয়সী মেয়েটাকে নিয়ে আছি অনেক বেশি কষ্টে। তার জন্য একটা বিছানা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক মতো একটা মশারীর ব্যবস্থাও করতে পারিনি। বিদুৎ নেই, কী হবে সারাটা রাত এক আল্লাহই জানেন।'
মমিনের সঙ্গে কথা বলার সময় তার ঘরের পাশেই তখন ছোট শিশুকে বুকে টেনে ধরে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিলেন আরেক নারী। তার নাম জমিলা বেগম। জমিলার তিন সন্তান। সব থেকে বড় মেয়ের নাম জয়নব, বয়স ৪ বছর; মেজো মেয়ে জিয়ামনির বয়স ২ বছর এবং কোলে থাকা জাকিয়ার বয়স মাত্র ৭ মাস।
ঘর পুড়ে ছাই, বাকি নেই কোনো আসবাবপত্র; এমনকি জামা-কাপড়ও। অন্য এক বাড়ি থেকে একটা পুরনো চাদর এনে বসে আছেন সন্তানদের নিয়ে।
কড়াইল বস্তির বাসিন্দা জমিলা বেগম টিবিএসকে বলেন, 'আমার তিনটা ছোট বাচ্চা। স্বামী রিকশা চালায়। সবাই মিলে একটা ঘরেই থাকতাম। কিন্তু এখন তো বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। ঘরের দেয়াল খুলে পড়ে যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার মা বেড়াইতে আইছিল। এখন এতগুলো মানুষ গ্রামের বাড়িতে যামু, সেই গাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো টাকাও নাই। দুপুরে কিছু মানুষ খিচুড়ি রান্না করে দিয়ে গেছে, সেসব খাইছি। রাইতে খাওয়ার এখনও কোনো ব্যবস্থা হয় নাই।'
শুধু মমিন ও জমিলা নন, ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় এমন চিত্র দেখা গেছে পুড়ো কড়াইল বস্তিতে। ছোট শিশুদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অন্ধকারে মশা-মাছি ও পোকা-মাকড়ের মধ্যেই রাত কাটছে এখানকার বাসিন্দাদের। ঘর-বাড়ির সঙ্গে অনেকের জমানো টাকা শেষ সম্বলটুকুও পুড়ে গেছে আগুনে।
ফিরোজ আলী নামের এক বাসিন্দা দেখালেন তার ঘরে থাকা ৩ লাখ নগদ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমার জীবনের শেষ সম্বল এই টাকাগুলো জমাইছিলাম। ঘরের জিনিসপত্রের সঙ্গে টাকাও সব পুড়ে গেছে। আমি এখন কি নিয়ে সংসার চালামু। ৪টা মাইয়া আর বউ নিয়ে আমার সংসার কেমনে চলব।'
প্রসঙ্গত, ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তির প্রায় দেড় হাজার ঘর। সব হারিয়ে বস্তিবাসী এখন নিঃস্ব। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন খোলা মাঠে, কেউ বা ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কোনোমতে রাত পার করার চেষ্টা করছেন।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ভয়াবহ আগুন লেগেছে কড়াইল বস্তিতে। কিন্তু কেন বার বার এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটছে? এর নানা কারণ ব্যাখা করছেন বস্তির বাসিন্দারা।
কড়াইল বস্তির বাসিন্দা নান্নু হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ঘরে এখন সিলিন্ডার, লাইনের গ্যাস, নানা কারণে আগুন লাইগা যায়। আবার কিছু খারাপ মানুষ আছে বস্তি আগুনে পুড়াইলে যাদের লাভ হয়।'
প্রসঙ্গত, ২৫ নভেম্বর বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট গিয়ে পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে মসজিদের মাইকে। গুলশান বনানী এলাকায় জ্বলে উঠেছে ঝলমলে আলো। অপরদিকে, গুলশান লেকপাড়ের নৌকায় বাড়ছে ভিড়।
সারাদিন কাজ শেষ করে নৌকায় চেপে পুড়ে যাওয়া ঘরের দিকে ছুটছেন কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা। এই নৌকাতেই গতকাল অগ্নিকাণ্ডের সময় জীবন বাঁচাতে পালিয়েছেন শত শত মানুষ।
নৌকার মাঝি ও কড়াইল বস্তির বাসিন্দা মো. সুমন মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'গতকাল এই নৌকায় কমপক্ষে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ পার করছি। কোনো পয়সা নেই নাই, কি করমু আগে তো মানুষের জীবন। আমার নিজের ঘরও পুড়ে গেছে আগুনে।'
রাত তখন ৮টা। পোড়া টিনের ভাঁজে উকি মারছে আকাশের চাঁদ। এই চাঁদের আলো আর কিছু মোমবাতির আলোতেই যে যেভাবে পারছেন শুয়ে পড়ছেন ঘুমানোর চেষ্টায়।
সুমন মাঝি যখন আমাদের নৌকায় করে নামিয়ে দিলেন গুলশানের লেকপাড়ে, দূর থেকে ঘুটঘুটে এক অন্ধকার নির্জন দ্বীপ মনে হচ্ছিল কড়াইল বস্তিকে। আমরা ফিরছি নিজ গন্তব্যে। আর মেহরিমা-জয়নবদের নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে রাতভর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের অভাগা বাবা-মায়েরা। রাত পোহালে আসলে কী হবে জয়নব-জাকিয়াদের ভাগ্যে?
