ছোট মেয়েকে জড়িয়ে শীতের রাত পার, কড়াইলের আগুনে সব হারিয়ে রিনার প্রশ্ন, 'হামরা এলা কোনঠে যামো?'
ভোরের আলো ফুটতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে গত রাতের আগুনের ক্ষত। রাজধানীর কড়াইল বস্তির বউবাজার এলাকা যেন এক মৃত্যুপুরী। ধ্বংসস্তূপ থেকে তখনো বেরোচ্ছে ধোঁয়া, বাতাসে পোড়া গন্ধ। ইটের গাঁথুনি আর টিনশেডের দু-তিনতলা অস্থায়ী ঘরগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সর্বনাশা আগুনে সর্বস্ব খুইয়ে সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিঃস্ব বাসিন্দারা।
কথা হয় বস্তির বেলতলা ক্লাবঘরের বাসিন্দা রিনা বেগমের (৪৫) সঙ্গে। বাসাবাড়িতে কাজ করেন তিনি। স্বামী নিরাপত্তা প্রহরী। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার। ভাড়া থাকতেন টিনশেড একটি ভবনের তৃতীয় তলায়। আগুনে তার সংসারের সব আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার চোখেমুখে এখন অনিশ্চয়তার ছাপ। কীভাবে আবার নতুন করে সংসারের সব জিনিস কিনবেন, সেই দুশ্চিন্তায় রিনার কপালে ভাঁজ।
শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে কীভাবে রাত কাটিয়েছেন, তা জানাতে গিয়ে কান্না সামলাতে পারছিলেন না তিনি। এখন কোথায় উঠবেন, আবার সব কিছু কীভাবে নতুন করে শুরু করবেন—বিলাপ করে সেসব কথাই বলছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিনা বলেন, 'কাল রাইতে হামরা মসজিদে ছিনো। মোর ছোট মেয়ের বয়স আট বৎসর। রাইত গেছে জারে [ঠান্ডায়] কাঁপতে কাঁপতে। নতুন করে কোনঠে উঠবো বুঝবার পাইতেছি না। হামরা এলা কোনঠে যামো?'
খোলা জায়গা, দোকান কিংবা মসজিদে—যে যেভাবে পেরেছেন, মানবেতরভাবে রাত কাটিয়েছেন। কেউ আধপেট খেয়েছেন প্রতিবেশীর বদান্যতায়, কেউবা রাত থেকে না খেয়েই আছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎসুক জনতার ভিড়। পোড়া ছাইভস্ম হাতড়ে কেউ কেউ খুঁজছেন শেষ সম্বলটুকু, যদি ধাতব কিছু পাওয়া যায়।
'আগুন থাইকা কি আমাগো মুক্তি নাই?'
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত আরেক ভুক্তভোগী জালাল উদ্দিন। পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী। জালাল বলেন, 'কিছু মাল-সামানা বাইর করতে পারছি, বাকি সব পুইড়া গেছে। আবার কিছু জিনিস মাইনষে চুরি কইরা লয়া গেছে।'
কথা বলতে বলতে চোখ মোছেন তিনি। জানান, কয়েক মাস আগে নতুন সংসার শুরু করেছিলেন। সেই স্বপ্নও আগুনে ভস্মীভূত। হতাশা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, 'আমাগো মতো বস্তির মাইনষের কি আগুনের হাত থিকা মুক্তি নাই?'
মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে গতকাল রাতের ভয়াবহ আগুন পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। পুলিশের প্রাথমিক হিসাবে, অন্তত দেড় হাজার ঘর পুড়ে গেছে। প্রতিটি ঘরের পেছনে ছিল অসংখ্য মানুষের আলাদা গল্প; সেসব গল্প রাতের অগ্নিকাণ্ডে এক নিমিষে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।
