বিদেশে পাচার ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ উদ্ধারে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীসহ ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী টার্গেটে
সরকার বিদেশে লুকানো ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি অঘোষিত সম্পদ শনাক্ত করার পর দেশের সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, শীর্ষ ব্যবসায়ী, ব্যাংকের মালিক এবং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের দেশ থেকে পাচার সম্পদ জব্দে নজিরবিহীন এক অভিযান শুরু করেছে।
এই প্রথমবার, সরকার নতুন আইনের আওতায় তাদের স্থানীয় সম্পদ থেকে সমপরিমাণ জরিমানা আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন কর অঞ্চল ইতোমধ্যে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিয়েছে—এ তথ্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক আহসান হাবিব। তিনি জানান, কয়েকজন অভিযুক্তের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধিরা বিদেশে সম্পদের উৎস ব্যাখ্যা করতে হাজির হলেও— অধিকাংশ ব্যাখ্যাই "অসন্তোষজনক" হওয়ায় সেগুলো নাকচ করা হয়েছে।
এসব ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করলে—বা আপিল করতে অস্বীকৃতি জানালে—সরকার পাবলিক ডিমান্ডস রিকভারি আইনের আওতায় সম্পদ পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম শুরু করবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি নজরে এসেছে, তা হলো একক একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশি সম্পদ। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর দেশীয় সম্পদ থেকেও সমপরিমাণ জরিমানা দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার এক কর কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "প্রথম ধাপে সাতজনকে বিদেশে শনাক্ত করা তাদের সম্পদের ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতিনিধিরা এসে বক্তব্যও দিয়েছেন। এসব ব্যাখ্যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বিদেশে সন্ধান পাওয়া সম্পদের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা প্রদান করার জন্য অক্টোবর মাসে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। জরিমানার অর্থ পরিশাধ না করা হলে, তাদের কিছু আইনি প্রক্রিয়া শেষে ওইসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে"– বলেন তিনি।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "সরকার কতটা সফল হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে অর্থপাচারকারীদের কাছে শক্ত বার্তা পাঠাতে আইন প্রয়োগ অব্যাহত রাখা জরুরি। বহু বছর ধরে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি—ফলে অবৈধ অর্থপাচার বেড়েই গেছে।"
আইনে কী বলা আছে
বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর আইনে ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো এমন বিধান যোগ করা হয়, যাতে বিদেশে রাখা কোনো অঘোষিত সম্পদমূল্যের সমপরিমাণ জরিমানা আরোপ করা যায়। এই আইন প্রযোজ্য সেইসব ব্যক্তির ক্ষেত্রেও, যারা আগে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, এবং পরবর্তীতে নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।
আগের সরকারগুলো বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এই বিধান যোগ হয়। আইনটির ২১ নম্বর ধারায় কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, কোনো বিদেশি অঘোষিত সম্পদের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ জরিমানা আরোপ করার। এতে বলা হয়েছে, "কোন নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শিত নয়, এরূপ কোন বিদেশস্থ সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেলে, ওই সম্পত্তি অর্জনের উৎস, বা প্রকৃতি সম্পর্কে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন বা ওই ব্যাখ্যা ট্যাক্স অফিসারের কাছ সন্তোষজনক প্রতীয়মান না হয়, সেক্ষেত্রে ওই সম্পত্তির বাজারমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে ওই করদাতার উপর আরোপ করবেন এবং আদায় করবেন।"
এরপর কৌশলে বিদেশে গিয়ে এস আলম পরিবারের সদস্যরাসহ গত সরকারের সময়ের প্রভাবশালী অনেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট সারেন্ডার করে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইনের আওতায়, বাংলাদেশি নাগরিকত্ব না থাকলে ওই ব্যক্তির কাছে আইনগতভাবে পাচারের অর্থ আদায় করা যেত না।
২০২৪ সালের আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট ধারায় কিছুটা পরিবর্তন এনে 'করদাতা বা জন্মসূত্রে বাংলাদেশী ছিলেন বা আছেন' – এমন একটি অংশ যোগ করে। অর্থাৎ, এখন কর্মকর্তারা সাবেক নাগরিকদের বিরুদ্ধেও আইন প্রয়োগ করতে পারবেন।
বিদেশে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান
গত ১৭ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সিআইসি বিদেশে ৪০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশীদের। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আলোচ্য সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের সাতটি শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া তদন্তকারীরা ৯টি দেশে অবৈধ অর্থে কেনা ৩৫২টি পাসপোর্ট শনাক্ত করেছেন—যার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ডমিনিকা, গ্রেনাডা, নর্থ মেসিডোনিয়া, মাল্টা ও তুরস্কের মতো দেশ।
ওই সময় সিআইসির মহাপরিচালক প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, "এখন পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি এটি 'টিপ অব দ্য আইসবার্গ'। আমাদের কাছে এখনো প্রচুর তথ্য রয়েছে, যা উন্মোচনে আরও সময় প্রয়োজন।"
অবশ্য অন্তর্বর্তকালীন সরকার দায়িত্বে আসার পর বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতি, অনিয়ম উদঘাটনে গঠিত অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৫ বছরে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে।
সরকারের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া
কর্মকর্তারা জানান, পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে এগোনো হচ্ছে। প্রথমে অভিযুক্তদের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বিদেশে তাদের নামে থাকা সম্পদের ব্যাখ্যা চাইছে কর অঞ্চলগুলো।
কিন্তু জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় উদ্ধারকৃত সম্পদের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানার জন্য তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্যাক্স কমিশনার টিবিএসকে বলেন, আমরা যাদেরকে নোটিশ পাঠিয়েছি, পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে জরিমানার অর্থ পরিশোধের জন্য—এক্ষেত্রে হয় তারা টাকা পরিশোধ করবে, অথবা ওই সময়ের মধ্যে আপিল করতে পারবে। "যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপিল করে, তাহলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে। তাতে কত সময় লাগবে তা বলা যাচ্ছে না" – বলেন তিনি।
অভিযুক্ত যদি আপিল না করে বা স্বেচ্ছায় অর্থ পরিশোধ না করে, তাহলে কী হবে – এমন প্রশ্নে তিনি বলে, "তাহলে আমরা আইন অনুযায়ী একাধিক নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া শেষ করে পাবলিক ডিমান্ডস রিকভারি আইন' অনুযায়ী অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেব।"
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমন উদ্যোগ
বাংলাদেশে এত বড় পরিসরে আগে কখনো সম্পদ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিআইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে নতুন আইনটি হওয়ার পর প্রথম একজন বাংলাদেশির যুক্তরাজ্যে সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়, যা তিনি তার রিটার্নে দেখাননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেখে সম্পদটি শনাক্ত হয়, এবং তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তার ওপর সমপরিমাণ অঙ্কের জরিমানা আরোপ করা হয়। তবে মামলাটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় থাকায়, ওই অর্থ এখনো আদায় হয়নি।
অর্থ উদ্ধার সহজ হবে না: বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "কর কর্তৃপক্ষ কর বা জরিমানা আদায় করলেও, মানি লন্ডারিং হয়ে থাকলে কাউকে যেন জবাবদিহির বাইরে যেতে না দেওয়া হয়—এটি নিশ্চিত করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "অভিযুক্তদের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে। এ আইনে অর্থপাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন গুণ জরিমানা, দেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তিকে কমিশনসহ অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনা উচিত।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ফার্মের একজন সিনিয়র এফসিএ টিবিএসকে বলেন, "এখানে বিশ্বাসযোগ্য ডকুমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ, কেননা দাবিনামা প্রতিষ্ঠা হবে এর ভিত্তিতে। বিদেশে থাকা সম্পদের যথাযথ ডকুমেন্ট না থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ আদায় সম্ভব হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "যাদের বিদেশে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু তার নামে দেশে সম্পদ নেই, তাহলেও বাস্তবে আদায় করা সম্ভব হবে না। আবার যদি কারো সম্পদ ব্যাংকে মর্টগেজ থাকে, তাহলেও ওই সম্পদ উদ্ধার করার সম্ভাবনা কম।"
তবে এনবিআরের সিআইসি'র সাবেক মহাপরিচালক মনে করেন, কোন ব্যাংকে যদি সম্পদ বন্ধক থাকে, তাহলে সরকারের দাবি আগে পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তাফা আবিদ খান বলেন, কর নীতি দিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
"হতে পারে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিদেশে থাকা সম্পদ পাচারের নয়, কিংবা সেখানে ট্যাক্সও পরিশোধ করা হয়েছে। এটি নিশ্চিত না কেবল স্থানীয় ফাইলে দেখায়নি বলে বাজারমূল্যে জরিমানা ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট করতে পারে কি?" – সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এনবিআরের সাবেক কর নীতি সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, মানি লন্ডারিংকে নিরুৎসাহিত করতে সব দেশেরই নিজের মত করে আইন রয়েছে। বাংলাদেশে গৃহীত এই আইন ভবিষ্যতে অর্থপাচার ঠেকাতে বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।
