সমেশপুর: বাংলাদেশের সবজি চারার অনন্য রাজধানী, মৌসুমে বিক্রি ৯০ কোটি
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সমেশপুর গ্রাম। রানি ময়নামতির বাংলো অবস্থিত এই গ্রামে। বাংলোর পূর্ব দিকে একটি সড়ক পাহাড়ের মতো ঢালু হয়ে নেমে গেছে উত্তর-পশ্চিমে। সড়কটি ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে কচি কচি সবজি চারার বেড। এই দৃশ্য পুরো গ্রামে। গত ৬০ বছর ধরে এই গ্রামে সবজির চারা উৎপাদন করছেন কৃষকরা। এখান থেকে এখন দেশের ৬৪টি জেলায় চারা সরবরাহ করা হয়। সারা দেশ থেকে পাইকাররা ভিড় করেন এখানে।
সমেশপুর আলাদাভাবে সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসংলগ্ন উপজেলার আরও তিনটি গ্রামে—কালাকচুয়া, নিমসার ও ঢাকলাপাড়া—উৎপাদন হচ্ছে চারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ভাদ্র থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত এই গ্রামগুলোতে অন্তত ৯০ কোটি টাকার চারা উৎপাদন হচ্ছে, যার সিংহভাগের জোগান দিচ্ছে সমেশপুর। মহাসড়কের কাছাকাছি হওয়ায় এখান থেকে দ্রুত সারাদেশে চারা পৌঁছে দেওয়া যায়।
বুড়িচং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিনা আক্তার জানান, উপজেলার এ চারটি গ্রামেই সবচেয়ে বেশি সবজির চারা উৎপাদন হয়। তবে সমেশপুর মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে এবং সারা দেশে উৎপাদনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'এই চার গ্রামের প্রায় ৩০০ জন উদ্যোক্তা চারা উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। চারা উৎপাদন ও বিপণন মিলিয়ে ৩ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।'
যেভাবে শুরু
সমেশপুরের বাসিন্দা মোতাহার হোসেন জানান, স্বাধীনতার পাঁচ-ছয় বছর আগে গ্রামের বাসিন্দা মো. ইউসুফ বাইরে থেকে বীজ এনে চারা উৎপাদন শুরু করেন। চারা উৎপাদন করে তিনি সফল হলে আশেপাশের সবাই উদ্বুদ্ধ হন।
মোতাহার বলেন, 'জমিগুলো উঁচু হওয়ায় পৌষ মৌসুমে পানি জমে না। এ কারণে এসব জমি চারা উৎপাদনের জন্য আদর্শ। গ্রামে চার হাজার মানুষ রয়েছেন। উদ্যোক্তা আছেন ১৪০ জন। হাতেগোনা দুই-একটি পরিবার ছাড়া বাকি সবাই সবজি চারা উৎপাদনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত রয়েছেন। আমি নিজেও চার দশক চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।'
উদ্যোক্তা নারায়ণ দেবনাথ জানান, তার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে চারা উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল; তিনি নিজেও তিন দশক ধরে এই পেশায় আছেন। তিনি আরও জানান, প্রত্যেক উদ্যোক্তার অধীনে পাঁচ থেকে দশজন শ্রমিক কাজ করেন।
সমেশপুর ও আশপাশের গ্রামের বর্তমান চিত্র
সম্প্রতি সমেশপুর, কালাকচুয়া ও ঢাকলাপাড়া ঘুরে দেখা যায়, ফুলকপি,পাতাকপি, টমেটো, মরিচ, ব্রকোলি ও বেগুনের বীজতলার বেডের ওপর ছাউনি দেওয়া হয়েছে। কৃষকরা চারা তোলা, পরিচর্যা ও বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ঢাকলাপাড়া গ্রামের উদ্যোক্তা আবুল কাশেম জানান, প্রায় ১৫ বছরের প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে তিনি এখন বছরে ছয় মাস ৬০ শতাংশ জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করেন। এতে তার খরচ হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। ছয় মাসে একই বেডে মোট চারবার বীজ বপন করা যায়। প্রায় ৩০ লাখ টাকার চারা বিক্রি হয়।
চান্দিনার মাধাইয়া থেকে চারা কিনতে আসা পাইকার জসিম উদ্দিন বলেন, এ এলাকার চারার গুণ ভালো। মারা যাওয়ার প্রবণতা কম। দামে সাশ্রয়ী ও ফলন বেশি হওয়ায় প্রান্তিক কৃষকরা এসব চারা লুফে নেন।
নিমসারের উদ্যোক্তা আবদুস সালাম জানান, বর্তমানে চারা রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই। কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে আরও বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব হতো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, উদ্যোক্তাদের ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'কৃষিবিভাগ তাদের বুদ্ধি, পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। আরও ভালো মানের বীজ যাতে তারা পান, আমরা সে সহায়তা করব।'
চারা রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, 'সবজির চারা নাজুক, সহনশীলতা কম। রপ্তানি করতে হলে ভালোমতো প্রসেসিং করতে হয়। এছাড়া ডেলিভারি দিতে হয় দ্রুততর সময়ের মধ্যে। এটা কঠিন।'