তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের রায়কে স্বাগত জানাল বিএনপি-জামায়াত
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা এই রায়কে নাগরিকদের ভোটাধিকার রক্ষার বিজয় এবং ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে একটি অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
আজ মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারই অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে।
তিনি বলেন, 'অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'এই ব্যবস্থায় কোনো কাঠামোগত দুর্বলতা থাকলে তা সংস্কারের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।'
আমীর খসরু বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকলে তা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।'
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দস কাজল বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এই রায়টি সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকার ব্যবস্থা আনয়ন করে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আপিল বিভাগ সেই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। আজকের রায়ের ফলে, সংবিধানে এই সরকার ব্যবস্থা অটোমেটিক্যালি পুনরুজ্জীবিত হলো, মানুষের ভোটের অধিকার আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু আদালত রায়ে বলেছেন, এই রায়ের কার্যকারিতা ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। এটি কার্যকর হবে আগামী চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।'
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দস বলেন, 'আজকের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, সেই রায়ের পরতে পরতে ত্রুটি ছিল। ফলে খায়রুল হকের রায় পুরোই বাতিল করেছেন আদালত।'
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, 'এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবে।'
জামায়াতে ইসলামীও এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। দলটি বলেছে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
আজ দুপুরে মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, 'সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই।'
তিনি বলেন, 'কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণেই শেখ হাসিনার সরকার ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারি চরিত্র অর্জন করেছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামী সর্বপ্রথম কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল। কাকতালীয়ভাবে ২০২৫ সালের এই ২০ নভেম্বরেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দিলেন। আমরা আদালত, আইনজীবী ও দেশবাসীকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।'
জামায়াতের এই নেতা বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো ইতিহাস নেই। তাই নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ তদারকি সরকার অপরিহার্য। অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন এই ব্যবস্থার মূল রূপকার।'
তবে তার দাবির স্বপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণ-আকাঙ্ক্ষার সরকার। আমরা আশা করছি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অতীতের মতো কোনো পাতানো নির্বাচন করার চেষ্টা করা হলে, দেশবাসীকে নিয়ে আমরা তা প্রতিহত করব।'
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর গোলাম আজম বরং দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। লেখক জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআন্দোলন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের দাবি তোলে। পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আজমের নাগরিকত্ব নিয়েও সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, 'আজকের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরেছে। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে। চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। অর্থাৎ সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠিত হবে।'
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই রায়কে 'সাংবিধানিক অরাজকতার বিরুদ্ধে মাইলফলক' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
আজ (২০ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ আহমাদ বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি ছিল, তা আবারও আইনগত মর্যাদায় ফিরে এসেছে।'
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ''আজকের রায়ে আপিল বিভাগ এই রায় বাস্তবায়নে 'প্রসেপেকটিভ ইফেক্ট' দিয়েছেন। অর্থাৎ, আগামী নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হবে, সেটি ভেঙে যাওয়ার পর কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। এই রায়ের ফলে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয়েছিল, সেটাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না বলে 'সাংবিধানিক' হিসেবে ঘোষিত হলো।''
তিনি বলেন, "তত্ত্বধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ঘোষিত হলো, এই বিষয়টি হয়তো আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে উঠে আসবে। আজ থেকে বাংলাদেশের মানুষ আগামী দিনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন, দিনের ভোট রাতে হবে না, মৃত মানুষ এসে ভোট দিয়ে যাবেন না, এরকম একটি গণতান্ত্রিক মহাসড়কে বাংলাদেশ চলা শুরু করলো বলে আমরা মনে করি।"
বিষয়টি কীভাবে আদালতে গড়াল
২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ রায় চ্যালেঞ্জ করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক রিভিউ আবেদন করেন।
একই ইস্যুতে বিএনপি, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামী এবং আরও একজন পৃথক রিভিউ আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগ।
১০ কার্যদিবস ধরে শুনানি শেষে গত ১১ নভেম্বর আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়। আপিল বিভাগ আজ (২০ নভেম্বর) নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন। একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
তবে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমিকভাবে বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি কার্যকর হবে না।
আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করেন।
বেঞ্চের বাকি ৬ বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
আদালত ঘোষণা করেছেন, ১৯৯৬ সালে ১৩তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন 'পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো'।
আদালত রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, আগের রায়টিতে রেকর্ড অনুযায়ী বেশ কিছু স্পষ্ট ত্রুটি ছিল। এসব ত্রুটির কারণে সেই রায়টি পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে।
বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন ড. শরীফ ভূঁইয়া; বিএনপির পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল; মির্জা ফখরুলের পক্ষে ব্যারিস্টার জয়নুল আবেদীন এবং জামায়াতের পক্ষে মোহাম্মদ শিশির মনির।
২০১১ সালের যে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়েছিল, তা নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক ও আইনি পর্যালোচনার পরই এই রায় এলো।
