নির্বাচনি আচরণবিধি: দল ও প্রার্থীকে দিতে হবে পৃথক অঙ্গীকারনামা, প্রার্থীর লঙ্ঘনে দলকেও গুনতে হবে জরিমানা
এই প্রথম সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীকে আচরণবিধি মেনে চলার জন্য পৃথক অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হবে—এমন নতুন বিধান করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকেও আর্থিক শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়া নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে বলছেন রাজনৈতিক দলের প্রতিধি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। আর ইসি বলছে, প্রয়োজনে পরিপত্র দিয়ে আরও স্পষ্ট করা হবে।
রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রদত্ত অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধির সব বিধান মেনে চলবে, এই মর্মে তফসিল-১- উল্লিখিত নমুনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় অঙ্গীকারনামাও জমা দিতে হবে।
এতে বলা হয়েছে, 'এই মর্মে অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমার দল এবং দল কর্তৃক মনোনীত সকল প্রার্থী "সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০২৫"-এর সকল বিধান মানিয়া চলিব। যদি আমার দল বা দল কর্তৃক মনোনীত কোন প্রার্থী এই আচরণ বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন করেন তাহা হইলৈ এতদসংক্রান্ত আইন এবং বিধিমালার বিধান অনুযায়ী প্রদত্ত শাস্তি মানিয়া লইতে বাধ্য থাকিব।' এখানে স্বাক্ষর করবেন দলের সভাপতি বা সমর্যাসম্পন্ন পদধারী বা সাধারণ সম্পাদক বা সমমর্যাদাসম্পন্ন পদধারী।
প্রার্থীর অঙ্গীকারনামা
কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হলে তাকে তফসিল-২-এ উল্লিখিত নমুনা অনুযায়ী অঙ্গীকার করতে হবে যে, তিনি সব বিধান মেনে চলবেন। যদি তিনি বা তার কোনো নির্বাচনি সহযোগী বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে প্রচলিত আইন বা বিধিমালার বিধান অনুযায়ী শাস্তি মানতে বাধ্য থাকবেন। এখানে স্বাক্ষর করবেন প্রার্থী ও দুইজন সাক্ষী ।
'প্রার্থী অপরাধ করলে দলকে শাস্তি—এটা কীভাবে হবে?'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জামায়াতের প্রতিনিধি শিশির মনির নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে দল ও প্রার্থীর অঙ্গীকারনামার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'ধরি, আমি আচরণবিধি ভঙ্গ করলাম, ছয় মাসের সাজা পেলাম। একই সময়ে আমার দলকেও দেড় লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে—এখন এমনই মনে হচ্ছে। ব্যক্তির অপরাধে দলকে শাস্তি কীভাবে দেওয়া হবে, এ বিষয় স্পষ্ট নয়।'
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব জহিরুল ইসলাম মুসা টিবিএসকে বলেন, 'প্রথমবারের মতো দল ও প্রার্থীর অঙ্গীকারনামা নেওয়া হচ্ছে—এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এখানে দল অঙ্গীকার করছে, আমার যে প্রার্থী আছেন, তারা অঙ্গীকার মানবেন। আবার প্রার্থী আলাদাভাবে এটা দিচ্ছেন, যে তিনি নিয়ম মেনে চলবেন। আর শাস্তির বিষয়ে প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ তার প্রার্থিতা বাতিলের বিধান আছে; এছাড়া জরিমানা হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'দলের ক্ষেত্রে তো প্রার্থিতা বাতিলের প্রশ্ন নেই। দলের ক্ষেত্রে তখন আরোপ হতে পারে জরিমান। এটা ভালো হয়েছে—সবাইকে একটা কাঠামোতে আনতে হবে। নাহলে আমাদের যে কালচার, দল দায় নেবে না, সেটা তো হতে পারে না। তবে প্রার্থী ও দলের শাস্তির বিষয়টা স্পষ্ট করলে আরও ভালো হতো।'
নির্বাচনি আচরণবিধি প্রণয়ন নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, 'আচরণিবিধির বিষয়গুলো প্রয়োজনে পরিপত্র দিয়ে আরও স্পষ্ট করা হবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা যে আচরণবিধি করেছি, এর বেশিরভাগই নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে নেওয়া। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি, ওয়েবসাইটেও রেখেছি। বিভিন্ন দল ও ব্যক্তি মতামত দিয়েছেন—সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে চূড়ান্ত করা হয়েছে।'
আচরণবিধি ভাঙলে ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দেড় লাখ জরিমানা এবং দলের জন্য দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিধান লঙ্ঘনে আরপিওতে প্রার্থিতা বাতিলেরও বিধান রয়েছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম টিবিএসকে বলেন, 'প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে দলকে শাস্তি—এটা আমি সমর্থন করি না। প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে প্রার্থীই শাস্তি পাবে। তবে দল তাদের প্রার্থীকে সতর্ক করতে পারে—আচরণবিধি ভঙ্গ করলে প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে, তাই যেন এমন কাজ না করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'দলের কেন্দ্র থেকে সারা দেশে বিভিন্নভাবে প্রচারণা পরিচালিত হয়। যেমন ধরুন, কোনো দলের প্রধান ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে গেলে তিনি হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট বা প্রচারপত্র ছড়াতে পারবেন না। যদি ছড়ানো হয়, তাহলে তা আচরণবিধি ভঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে এই আচরণবিধি অনুযায়ী দলের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।'
আচরণবিধিতে উল্লেখযোগ্য যা আছে
আচরণবিধিতে প্রথমবারের মত নির্বাচনি প্রচারে পোস্টার ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। ভোটের প্রচারে ড্রোন ব্যবহার করা যাবে না। আচরণবিধিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বিদেশে প্রচারণাতেও। একজন প্রার্থী তার সংসদীয় আসনে ২০টির বেশি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন না। প্রচার-প্রচারণাসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করা যাবে না।
