মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীদের ঘিরে বিএনপিতে অন্তঃকোন্দল, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রার্থী বাছাইয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসা এলেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের একাংশ অভিযোগ করেছেন, 'ত্যাগী ও যোগ্য' নেতৃবৃন্দকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন।
গত ৩ নভেম্বর ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দলীয় কোন্দলের জেরে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন।
এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। জানা গেছে, প্রতিটি আসনে কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ চলছে এবং সাংগঠনিক টিম কাজ করছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী টিবিএসকে বলেন, "সংঘর্ষ বা বিশৃঙ্খলার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেককেই বহিষ্কার করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "নেতাকর্মীদের নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, তার বিষয়ে আপত্তিও থাকতে পারে। তবে প্রকাশ্যে রাস্তা বা রেললাইন অবরোধ করা যাবে না। যারা এসব করছে, তাদের বিরুদ্ধে দল তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।"
প্রার্থী ঘোষণার একদিন পর, গত ৪ নভেম্বর, মাদারীপুর-১ আসনের প্রার্থী কামাল জামান মোল্লার প্রার্থিতা স্থগিত করে দলটি। সূত্র জানায়, চূড়ান্ত নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগে ২১টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করছে বিএনপি।
প্রার্থী ঘোষণার পর দেশজুড়ে সহিংসতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গতকাল সোমবার (১০ নভেম্বর) মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন আরিফ মীর (৪০)। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আরও একজন, ইমরান খান (২২), গুলিবিদ্ধ হন। নিহত আরিফ মীর মুন্সিগঞ্জের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকার বাসিন্দা।
রোববার (৯ নভেম্বর) ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া এম. ইকবাল হোসেন ও মনোনয়নবঞ্চিত নেতা আহম্মেদ তায়েবুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় অসুস্থ হয়ে তানজিম আহমেদ আবিদ (৩০) নামে ছাত্রদলের এক কর্মীর মৃত্যু হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৮ জন আহত হন। এ ঘটনায় গৌরীপুর উপজেলা বিএনপির ৫ নেতাকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ বহিষ্কার করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের দলীয় প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে হামলা চালানো হয়। একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী জনসংযোগে প্রবেশ করে গুলি চালায়। এতে এরশাদ উল্লাহসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধদের একজন সরওয়ার হোসেন বাবলা পরে মারা যান।
কুমিল্লা-৯ আসনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে সামিরা আজিম দোলা-সহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। রোববার উপজেলার কান্দিরপাড় ইউনিয়নের ছনগাঁও এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ফারুক আলম ও বহিষ্কৃত নেতা নাহিদুজ্জামান নিশাতের সমর্থকদের উত্তেজনার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি জাবেদ মাসুদ মিল্টনকে মনোনয়ন না দেওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হন। গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে গাংনী বাজারে এ সংঘর্ষ ঘটে।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন না পাওয়ায় বিএনপি নেতা এম. এ. হান্নানের সমর্থকরা সড়ক অবরোধ ও মশাল মিছিল করেন। পরে ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ ও অবরোধ চালান তারা।
এদিকে, মাগুরা-২ আসনে ঢাকা দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তার সমর্থকরা মাগুরার মহম্মদপুর, শালিখা ও সদর উপজেলার চার ইউনিয়নে বিক্ষোভ করেন। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিতায় রায় চৌধুরীকে 'অযোগ্য প্রার্থী' দাবি করে রবিউল ইসলাম নয়নকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় তার সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে দলীয় প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লার সমর্থকদের ওপর হামলা, বাড়িঘরে ককটেল বিস্ফোরণ ও অফিস ভাঙচুরের অভিযোগে বিক্ষোভ মিছিল করেছে মনোনয়নবঞ্চিত ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহ্বায়ক শরিফ উদ্দিন জুয়েলের সমর্থকরা।
এদিকে, টাঙ্গাইল-৩ আসনে এস. এম. ওবায়দুল হক নাসিরের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন নেতাকর্মীরা।
বগুড়া-১ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী রফিকুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যায়িত করে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রংপুর, শেরপুর ও চাঁদপুরেও প্রার্থিতাবঞ্চিত নেতাদের অনুসারীরা বিক্ষোভ করেছেন।
কুমিল্লা-৬ আসনে হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াসিনকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে নগরীতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী শাহজাহান মিঞার বদলে শাহিন শওকতকে প্রার্থী করার দাবিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন শাহিন শওকতের অনুসারীরা।
রংপুর-৩ (সদর) আসনে প্রার্থিতাবঞ্চিত মাহফুজ উন নবী ডনের সমর্থনে নগরীতে গণমিছিল বের হয়।
রাজশাহী-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডলের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রার্থিতাবঞ্চিত তিন প্রার্থীর অনুসারীরা।
শেরপুর-১ (সদর) আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম মাসুদের অনুসারীরা।
নওগাঁ-৪ আসনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
সাতক্ষীরা-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় 'গরিবের ডাক্তার' হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ডা. মো. শহিদুল আলমের সমর্থনে সড়ক অবরোধ ও হরতাল পালন করা হয়।
এছাড়া, নাটোর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে লালপুর-গোপালপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন প্রার্থিতাবঞ্চিত ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনের সমর্থকরা।
দলীয় সূত্র জানায়, যেসব আসনে অন্তর্কোন্দল রয়েছে, সেখানে উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। বঞ্চিত নেতাদের বিকল্পভাবে মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
দলের হাইকমান্ড ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সহিংসতা ঠেকাতে প্রার্থী বাছাই পুনর্বিবেচনা করছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে কয়েকটি আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের সম্ভাবনাও রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
