সিলেট-৪ আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী: ‘বহিরাগত’ আরিফে আপত্তি ‘লোকাল’ হাকিমের অনুসারীদের
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর সিলেটে দলটির মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। বিশেষত সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট–কোম্পানীগঞ্জ–জৈন্তাপুর) আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।
এই আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কাউকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাথে বৈঠক করে এসে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, তাকে সিলেট-৪ আসনের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
আরিফের এমন ঘোষণা মানতে নারাজ বিএনপির অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তাদের কয়েকজন এলাকায় প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। বিশেষত গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল হাকিম চৌধুরীর সমর্থকরা প্রতিদিনই আরিফুল হকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। আরিফকে সিলেট-৪ আসনে 'বহিরাগত' দাবি করে এই আসনে 'লোকাল' প্রার্থী দাবি জানাচ্ছেন তারা।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে জন্ম নেওয়া আরিফুল হক চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের দুইবারের মেয়র ছিলেন। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরের স্থায়ী বাসিন্দা।
তবে আব্দুল হাকিম অনুসারীদের দাবি, আরিফুল হক নগরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। গোয়াইনঘাট–কোম্পানীগঞ্জ–জৈন্তাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসনের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি এই এলাকায় বহিরাগত।
আব্দুল হাকিম চৌধুরী গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের দুইবারের চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বাড়িও ওই উপজেলায়। তাকে 'লোকাল প্রার্থী' দাবি করে এই আসনে হাকিমকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি করছেন তার অনুসারীরা।
এ দাবিতে গত শুক্রবার ও শনিবার দুই রাত এলাকায় মশাল মিছিল করেছেন হাকিম অনুসারীরা। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথক মিছিল করেন তারা।
মিছিলে অংশগ্রহণকারী কর্মীরা 'লোকাল চাই, হাকিম ভাই', 'আর নয় বিদেশি, এবারে স্বদেশি', 'হাকিম ছাড়া মানব না' ইত্যাদি স্লোগান দেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাত দুইটার পর কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তত ১৩টি স্থানে দলীয় প্রতীক 'ধানের শীষ'-এর মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুল হাকিম চৌধুরীর সমর্থনে খণ্ড মিছিল বের হয়। একই সময়ে এই আসনের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিন আহমদের সমর্থকরাও 'লোকাল চাই, হেলাল ভাই চাই' স্লোগান দেন।
এই ব্যাপারে আব্দুল হাকিম চৌধুরী বলেন, 'দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমি তা মেনে নেব। তবে জামায়াতপন্থী বা বাইরে থেকে আনা প্রার্থী হলে এখানে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ভোটাররা স্থানীয় মুখ দেখতে চায়।'
একই দাবি জানিয়েছেন হেলাল উদ্দিন আহমদও। তিনি বলেন, 'দলীয় হাই কমান্ড এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। আমি স্থানীয় প্রার্থী, এলাকার মানুষ আমাকে চায়। দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত আমি প্রচার চালিয়ে যাব।'
তবে বিক্ষোভ সত্ত্বেও এই আসনে প্রচার শুরু করেছেন আরিফুল হক চৌধুরী। রোববার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাথে মতবিনিময় করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী বলেন, 'আমি নিজেও এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। যাকে দল মনোনয়ন দেবে, আমরা সবাই মিলে তার পক্ষে কাজ করব।'
উল্লেখ্য, গত ৩ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রার্থী তালিকায় দেখা যায়, সিলেট-১, সিলেট-২, সিলেট-৩ ও সিলেট-৬ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। তবে সিলেট-৪ ও সিলেট-৫ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি।
প্রার্থী ঘোষণার পরদিন বিএনপি হাইকমান্ড থেকে ঢাকায় তলব করে নেওয়া হয় আরিফুল হককে। তিনি সিলেট-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে এ আসনে দলের চেয়ারপার্সনের আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদিরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
পরে গত বুধবার দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে আরিফুলের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে আরিফুল জানান, দলের চেয়ারপার্সন তাকে সিলেট-৪ আসনে নির্বাচন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। দ্রুত এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হবে।
৬ নভেম্বর রাতে ঢাকা থেকে মনোনয়ন নিয়ে সিলেট ফেরার পর ৭ নভেম্বর শুক্রবার বাদ জুমা গোয়াইনঘাটের রাধানগর বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করে প্রয়াত এমপি দিলদার হোসেন সেলিমের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেন।
আরিফুল হক বলেন, 'দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাকে আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন। খুব শীঘ্রই দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে।'
তিনি বলেন, 'এই আসনের প্রতিটি অলিগলি আমার পরিচিত। আমি জনগণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত। দলের মনোনয়নে যদি নির্বাচিত হই, তাহলে প্রথম এক বছরের মধ্যেই স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করব। যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা সবাই আমাদের ত্যাগী ও সম্মানিত নেতা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব।'
এদিকে আরিফুল হক এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ায় তার সমর্থকদের মধ্যে উল্লাস করতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, 'আরিফুল হক কাজের মানুষ। সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের হাত ধরে উন্নয়ন করতে শিখেছেন। যার কারণে সিলেট সিটি করপোরেশনে দুই বার মেয়র নির্বাচিত হয়ে উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছেন যা আগের মেয়র দ্বারা সম্ভব হয়নি। তিনি সিলেট-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে অবহেলিত এ জনপদে উন্নয়নে অতিথের সকল রেকর্ড ভেঙে যাবে।'
এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সামসুজ্জামান জামান, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দীন ও সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিমের স্ত্রী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম।
