নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে: লুট হওয়া অস্ত্রের হদিস নেই, বাড়ছে শঙ্কা
জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন স্লোগানের বদলে গুলির শব্দে তত অনুরণিত হচ্ছে। মাত্র এক বছরে চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় খুন হয়েছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে গুলিতেই খুন হয়েছেন ২২ জন। বাকিদের পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধে ১৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে, যা শহরের নির্বাচনি প্রচারণাকে কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
সম্প্রতি এক জনসংযোগে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর কয়েক হাত সামনে থাকা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলাকে পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টানা সাত-আট রাউন্ড গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
এর কয়েকদিন আগেই হাটহাজারীর মদুনাঘাট ব্রিজের কাছে অতর্কিত হামলার শিকার হন ব্যবসায়ী ও বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিম। মোটরসাইকেলে চেপে আসা অস্ত্রধারীরা তার গাড়িতে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। ২২ রাউন্ড গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন হাকিম, গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালকও। পুলিশ বলেছে, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করা হয় হাকিমকে।
এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের এক বিশাল চক্র। এর মধ্যে অনেক অস্ত্রের উৎস জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র। ওই সময় লুট করা হয় ৯৪৮টি অস্ত্র। এর মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত ৭৯৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা গেলেও ১৫৫টি এখনও নিখোঁজ।
লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে টুয়েলভ বোর শটগান, চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল ও সাবমেশিন গান (এসএমজি)। পুলিশের প্রতিবেদন বলছে, লুট হওয়া অস্ত্রের কিছু অংশ অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, যা জননিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৩৫৯টি শটগান, ৮৭টি চাইনিজ রাইফেল, ৬৮টি নাইন এমএম পিস্তল, ১৮৯টি গ্যাস গান, ৫৪টি এসএমজি এবং বেশ কয়েকটি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার রয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও চাঁদপুর, বাগেরহাট থেকে এসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বলছে, শটগান ও পিস্তল সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ এগুলো সহজে লুকানো যায়, অপরাধে ব্যবহারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অপরাধীরা এসব অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি, সন্ত্রাসী হামলা বা রাজনৈতিক সহিংসতা চালাতে পারে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম শহরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো ৪৬ অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছিল পুলিশ। তবে এর মধ্যে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে মাত্র ২০ জনকে। মাত্র দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গত বছরের আন্দোলনে চট্টগ্রামে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। নগরীর সাত থানায় ৬৫টি মামলা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'ফিল্মি স্টাইলে ঘোষণা দিয়ে একের পর এক খুনের ঘটনার ফলে নির্বাচনেও প্রভাব পড়বে। অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। আরে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়াও শঙ্কার বিষয়। নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসীদের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে সতর্ক করে বলেন, এটি 'নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা' হতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই পরিস্থিতি নির্বাচনি স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি এবং এটি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অপরাধী চক্রগুলোর লাগামহীন প্রভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে।
এলাকার দখল ও অস্ত্র
এই সহিংসতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পুরোনো সব অপরাধী চক্র।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির-সমর্থিত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত বড় সাজ্জাদ ১৯৯৯ সালে কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খানকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেন। ধারণা করা হয়, তিনি বিদেশ থেকে অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং বায়েজিদ, চাঁদগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকা তার একটি 'প্রক্সি আর্মি বাহিনী' নিয়ন্ত্রণ করে। বাবলার হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে পুলিশ ও বাবলার পরিবার।
বড় সাজ্জাদের বিশ্বস্ত সহযোগী ছোট সাজ্জাদ ২০১৯ সালে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেম। তিনি কারাগারে বসেই অনুগত সশস্ত্র অনুসারীদের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে তিনি স্থানীয় ব্যবসা, পরিবহন রুট ও চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছেন।
মাঠে থেকে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন রাউজানের টার্গেট কিলিং এক্সপার্ট রায়হান আলম। বাবলা ও তাহসিনসহ সাম্প্রতিক একাধিক হত্যাকাণ্ডের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ফটিকছড়ির দক্ষ শ্যুটার মোবারক হোসেন ইমনও হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র-সংক্রান্ত বিভিন্ন হামলায় জড়িত।
এই অপরাধী চক্রগুলো চট্টগ্রামকে যেন অদৃশ্য সীমানায় বিভক্ত একটি শহরে পরিণত করেছে, যেখানে ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রয়োগ করা হয় সহিংসতার মাধ্যমে।
সিএমপির ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) আমিরুল ইসলাম এই অপরাধী চক্রকে দমনের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, 'বড় সাজ্জাদ বিদেশ থেকে চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, আর রায়হান তার প্রধান বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করছেন। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা একাধিক অভিযান পরিচালনা করছি।'
আতঙ্কের নগরী
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশ এবং র্যাব মিলে চট্টগ্রাম থেকে ১৪৫টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে চট্টগ্রামে অপরাধ বাড়ছে।
র্যাব-৭-এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এ আর এম মোজাফফর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সাম্প্রতিক ঘটনায় যেসব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, এর সঙ্গে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের মিল পাওয়া যায়নি। এগুলোর মধ্যে দেশি একনালা বন্দুক ও ওয়ান শ্যুটারগান ছিল। এছাড়া বিদেশি অস্ত্রের ব্যবহারও হয়েছে। দেশীয় অস্ত্রগুলো চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় তৈরি হয়।'
বাঁশখালীর উপকূলীয় ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকা, কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, ঈদগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব দেশীয় অস্ত্র তৈরি করা হয়। একনলা বন্দুক, এলজি, কাঠের বাঁটযুক্ত রাইফেল, পাইপগান, ওয়ান শ্যুটারগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি হয় এসব জায়গায়। ৩০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয় এসব অস্ত্র। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়েও বিদেশি অস্ত্র ঢুকছে। ফলে অবৈধ অস্ত্রের গোপন বাজার গড়ে উঠেছে।
উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষণগণনা
বায়েজিদ, চান্দগাঁও ও রাউজানে রাতের বেলা কোন রাস্তা অরক্ষিত থাকে, তা দেখেই বাসিন্দারা এখন নিরাপত্তার বিষয়টি আঁচ করেন। বিক্ষিপ্ত গুলির শব্দ ও মোটরসাইকেলে মুখোশধারী ব্যক্তিদের আনাগোনা এখন পরিচিত বিপদে পরিণত হয়েছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অস্ত্রের এই লাগামহীন বিস্তার কেবল জননিরাপত্তাই বিঘ্নিত করবে না, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও নষ্ট করবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ মো. সাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'অবৈধ অস্ত্রের রুট সম্পর্কে সরকারি নথিতে নিশ্চয় তথ্য আছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা রাখতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হলে এগুলো নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার হতে পারে। এগুলো নির্বাচনি পরিবেশকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।'
সিএমপির সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আমিনুর রশিদ বলেন: 'স্থানীয়ভাবে তৈরি ও বিদেশি অস্ত্র এবং গত বছরের বিক্ষোভে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চলছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানও অব্যাহত আছে।'
তবে নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারি প্রচেষ্টা এবং দৈনন্দিন বাস্তবতার মধ্যে স্পষ্ট বৈসাদৃশ্য ফুটে উঠছে। রাতে এখনও গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে মানুষ, ক্ষমতার ভারসাম্যের নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র চক্রগুলো। এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের।
