ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধ ও ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে অবৈধ ও ভ্রাম্যমাণ দোকান উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার থেকে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের(ডাকসু) সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুবায়ের ও সদস্য সর্বমিত্র চাকমা। অন্যদিকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে হকারদের সঙ্গে নিয়ে শনিবার রাতে মিছিল করেছেন কয়েকটি বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরই প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা বিক্ষোভ করেছেন ডাকসুর কয়েকজন নেতা।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
গত শনিবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও তাদের মারধর করা হয় বলে দাবি করেন ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা।
রমনা কালীমন্দির গেটের কাছে 'দার্জিলিং মোমো' নামে ভাসমান মোমো দোকানের বিক্রেতা মো. মহীনুদ্দিন বলেন, 'তারা যখন আসছিলেন, আমরা অনেকে সরে যাচ্ছিলাম। তারপরও আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়েছে। আমি দোকান নিয়ে সরে যাচ্ছিলাম, তবুও আমার দোকানটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।'
পরে রাত ৯টায় উচ্ছেদ হওয়া হকার ও দোকানদাররা মিছিল করেন ক্যাম্পাসে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রসংগঠন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সংহতি জানিয়ে অংশ নিতে দেখা গেছে।
এদিকে ক্যাম্পাসে নিবন্ধনবিহীন দোকানদার ও হকারদের মিছিলের প্রতিবাদে রাত ১১টার দিকে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুবায়েরসহ বিভিন্ন হল সংসদের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানিয়ে প্রক্টর অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেন।
পরে রাত সাড়ে ১১টায় প্রক্টরের অফিসে কয়েকজন সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং হকারদের সঙ্গে মিছিলকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ কয়েকটি দাবি জানান। এ সময় হকারদের নিয়ে মিছিলকারী শিক্ষার্থীদের 'শোকজ' করা হবে বলে জানান সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম।
অবৈধ দোকান ও ভাসমানদের উচ্ছেদ যে কারণে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি রাস্তা গেছে। ক্যাম্পাসের পাশেই তিনটি বড় হাসপাতাল রয়েছে, আরেক পাশে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকা।
তবে যান চলাচলের কোনো নিয়মনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাগুলোতে নেই। পাশাপাশি বহিরাগত, ভবঘুরে ও ভাসমান মানুষের অবাধ চলাচলে নারী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগছেন। বিভিন্ন সময়েই ঘটছে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। এছাড়া ভাসমানদের অনেকে ক্যাম্পাসে মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এমন অভিযোগও রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদা আদায় করার অভিযোগ বহুদিনের। প্রক্টরিয়াল টিমের কারও কারও বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০২৩ সালে প্রক্টরিয়াল টিমের একজনকে বহিষ্কার ও ছয়জনকে সতর্কও করেছিল প্রশাসন। এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় অবৈধ ও ভাসমান দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুনরায় এই দোকানগুলো টিএসসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় বসতে থাকে। প্রশাসনও তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। এবারের ডাকসু নির্বাচনে বেশিরভাগ প্যানেল ও প্রার্থী তাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসে বহিরাগত যান নিয়ন্ত্রণ ও ভাসমান হকার ও ভবঘুরেদের উচ্ছেদের কথা বলেন।
ছাত্রশিবিরের ইশতেহারের বলা হয়েছিল, ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে বহিরাগত যান নিয়ন্ত্রণ, ভাসমান হকার ও ভবঘুরেদের উচ্ছেদ করা হবে। এছাড়া ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোনে ভাগ করে যানবাহন ও বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
কেন বিরোধিতা করছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো?
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিবন্ধিত এই দোকানগুলো উচ্ছেদের প্রতিবাদে শনিবার রাত ৯টায় হকার ও দোকানদারদের মিছিলে সংহতি জানিয়ে অংশ নেয় কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী।
ওই মিছিলে অংশ নেওয়া বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর অ্যাক্টিভিস্ট ইসরাত জাহান ইমু টিবিএসকে বলেন, 'কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এই উচ্ছেদগুলো হচ্ছে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে যে দোকানগুলো আছে, সেখানে এই উচ্ছেদগুলো হচ্ছে না। অর্থাৎ সব জায়গায় হচ্ছে না। ফলে এখানে চাঁদার বিষয় আছে বা "প্রক্টরিয়াল টিম ফাও খায়"—এই ধরনের অভিযোগ তো আগেও ছিল। এর পেছনে আরও কারণ আছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার।'
তিনি আরও বলেন, 'হকারদের মারধর করা, দোকানপাট ভাঙচুর করা নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ ছিল। অনেকের দোকানের ভেতর সারাদিনে যে আয় ছিল, সেই ক্যাশটুকু নিয়েও বের হতে দেয়নি। এই মানুষগুলোর শেষ সম্বল এভাবে শেষ করে দেওয়া উচিত না। একটা মানুষ যদি হকার না, সে যদি টোকাইও হয়, তাহলেও তো এধরনের অমানবিক ব্যবহার করতে পারে না। ডাকসু কিংবা ছাত্রসংসদ কাউকে তো সে এখতিয়ার দেয় না।'
উচ্ছেদ কার্যক্রমে ডাকসুর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক
এদিকে উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের কাঠামোগত বা অবকাঠামোগত পরিবর্তন কিংবা পদক্ষেপই হোক না কেন, বাস্তবায়নের ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই রয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার দায়িত্ব ডাকসুর নয়; তা পুরোপুরি প্রশাসনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন টিবিএসকে বলেন, 'ডাকসুর এই ধরনের হস্তক্ষেপ এক ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কারণ এই বিষয়গুলো সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডি আছে। ডাকসু যদি এসব দায়িত্ব পালন করে, তাহলে অতীতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল যে ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল, ডাকসুও সেরকম হয়ে যাবে।'
তবে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম ফরহাদ টিবিএসকে বলেন, 'প্রশাসন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অবৈধ কাজগুলো চলছে, তার মানে প্রশাসন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না। সেখানে ডাকসুর সুপারভাইজিং লাগবে নিশ্চিতভাবে। নাহলে ক্রসচেক বা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স কী করে হবে?'
তিনি আরও বলেন, 'ডাকসু যদি আমার ক্যাম্পাস নিরাপদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ভলিউন্টারি ওয়ার্ক করে, তাহলে সমস্যা কোথায়, বাধা কোথায়? ডাকসুর দায়িত্বই ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের ভয়েস এডভোকেসি করা। এতে আমার পার্টিসিপেশন থাকবে না? প্রশাসনের লোকজন থাকবে, আমারও হাজির থাকতে হবে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সহকারী রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ডাকসু হোক আর যা-ই হোক, ছাত্র ছাত্রই। ছাত্রদের প্রক্টরিয়াল শৃঙ্খলার কোনো কাজে লাগানোই আমাদের টার্গেট নাই। ডাকসুকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি না। উচ্ছেদ কার্যক্রমে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।'
'পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, 'এই ভবঘুরে বা হকারদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর এদের সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ বা ইলেক্ট্রিক্যাল কাজ কিংবা গবাদি পশু পালনসহ নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে জব মার্কেটের সাথে পরিচয় করাতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান এভাবে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক পরিবেশ, একাডেমিক পরিবেশ—সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমেই এগিয়ে আসতে হবে।'
