অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়লেও ব্যয় কমেছে ১,০৫৭ কোটি টাকা
চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬)-এর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে এ সময়ে ব্যয় কমেছে ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা।
রোববার প্রকাশিত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১২ হাজার ১৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৩ হাজার ২১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৬০৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরে সরকারের লক্ষ্য—এডিপির আওতায় ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় করা।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাধারণত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ হার ৭ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জটিলতা, টেন্ডার বিলম্ব, ঠিকাদারের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এডিপি বাস্তবায়নে এ ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সরকারের পতনের কারণে দেশে কার্যত কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম হয়নি। এ বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। ইতোমধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বছরের শুরু থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে গত সরকারের পতনের পর যেসব প্রকল্পে ঠিকাদাররা সরে গিয়েছিলেন, রাজনৈতিক কারণে তাদের অনেকেই এখনো ফিরে আসেননি। ফলে বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল সবচেয়ে কম। চলতি বছরের শুরুতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় জানুয়ারি থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি আবারও শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ইনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় আরও কম হতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাস্তবায়ন কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, "অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, সাধারণত অর্থবছরের প্রথম দিকে বাস্তবায়নের হার কম থাকে। তবে এবার নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের গতিকে আরও ধীর করবে। নির্বাচনের আগে ও চলাকালে উন্নয়ন কার্যক্রম গতি হারাবে, আর নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসার পরও তাদের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সময় লাগবে। ফলে পুরো অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার আশানুরূপ বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা নেই।"
তিনি আরও আশঙ্কা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের কারণে এডিপি বাস্তবায়ন এ বছর গতিশীলতা হারাবে এবং গত কয়েক বছরের তুলনায় নিম্নগতি বজায় রাখবে।
এদিকে, চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, গত বছরের জুলাইয়ে সরকার পতনের পর যেসব প্রকল্পে ঠিকাদার চলে গিয়েছিল, সেসব প্রকল্পে পুনরায় ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, সরকারি ক্রয় বিধিমালার কারণেও অনেক প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব হচ্ছে, যার ফলে ব্যয় বাড়ছে না। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নতুন বিধিমালা অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানের অপেক্ষায় আছে। তখনই এডিপিতে অর্থ ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
এদিকে, সম্প্রতি নতুন সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো নতুন বিধিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফলে আগামী মাসগুলোতে অর্থ ব্যয়ের গতি বাড়বে বলে আশা করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা (৪ দশমিক ০২ শতাংশ)।
এ সময় বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান বাবদ ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৫ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা (৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ)।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় হয়েছে ৭৭৭ কোটি টাকা।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫ শতাংশের কম। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এখনো কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। আরেকটি উচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাস্তবায়নের হার ১ দশমিক ১৩ শতাংশ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং সেতু বিভাগের ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, যার বাস্তবায়নের হার ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৭ শতাংশ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
