২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এডিপি ব্যয়ে সর্বনিম্ন রেকর্ড
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সরকারি ব্যয় রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলিয়ে এডিপি বরাদ্দের মাত্র ২৮ হাজার ৪৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক ইতিহাসে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এটিই সর্বনিম্ন এডিপি ব্যয়। সংস্থাটির এডিপি বাস্তবায়নসংক্রান্ত ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ব্যয়ের পরিসংখ্যান সংরক্ষিত রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, সরকার পতন ও প্রশাসনিক অস্থিরতার মধ্যেও গত অর্থবছরের একই সময়ে এর চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছিল সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এডিপিতে ব্যয় হয়েছিল ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। এর আগের দুই অর্থবছর—২০২৩-২৪ ও ২০২২-২৩—এই সময়ে এডিপি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ৪৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
আইএমইডির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট এডিপি বরাদ্দের ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ বাস্তবায়ন হার ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল যথাক্রমে ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এডিপি বাস্তবায়নের গতি এখনো মন্থর। প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জটিলতা, টেন্ডার বিলম্ব, ঠিকাদার সংকট এবং আমলাতান্ত্রিক ধীরগতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে সরকার এডিপির মাধ্যমে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও সরকারের পতনের কারণে কার্যত কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম হয়নি। সে কারণে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে স্বাভাবিক গতি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বছরের শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে অর্থ ব্যয়ের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
তবে সরকার পতনের পর রাজনৈতিক কারণে যেসব প্রকল্পে ঠিকাদাররা কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাদের বড় অংশ এখনো ফিরে আসেননি। ফলে অনেক প্রকল্পের কাজ আটকে আছে। পাশাপাশি নতুন ক্রয় নীতিমালার অনুমোদন প্রক্রিয়ার জটিলতায়ও বহু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে দেরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে এডিপি বাস্তবায়নে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, "এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার পেছনে একাধিক কাঠামোগত কারণ রয়েছে। দীর্ঘদিনের দুর্বল রাজস্ব আহরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি রাজস্ব সক্ষমতার ওপর স্থায়ী চাপ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি সরকারের প্রকল্প গ্রহণের মাত্রা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "অতিরিক্ত সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ, দুর্বল প্রকল্প বাছাই এবং জন প্রশাসনের সীমিত সক্ষমতা মিলিয়ে সরকারি বিনিয়োগ বাস্তবায়নের ক্ষমতা আরও দুর্বল হয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি আশ্চর্যজনক নয়; বরং সময়ের সঙ্গে তৈরি হওয়া একটি কাঠামোগত দুর্বলতার ফল। এর প্রভাবে সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাতের বিনিয়োগেই দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে যখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কার্যক্রম দুর্বল থাকে, তখন শুধু বাজারের ওপর নির্ভর করে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করা বাস্তবসম্মত নয়।"
তিনি বলেন, "এই প্রেক্ষাপটে অন্তত কিছুটা লক্ষ্যভিত্তিক ও কৌশলগত সরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা জরুরি ছিল। কারণ সরকারি বিনিয়োগ একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করে—যা বেসরকারি খাতের উদ্যোগ, বিশেষ করে নির্মাণ ও কৃষি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, "নির্বাচনের আগে সরকার মূলত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে নীতিনির্ধারণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমে যায়। নির্বাচনের পর সরকারের উচিত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চগতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়া—বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ জোরদার করা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে।"
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশীদ টিবিএসকে বলেন, নির্বাচনের কারণে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরাবরের মতোই দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে একটি স্থবিরতা বিরাজ করছে, যা সহজেই লক্ষণীয়।
তিনি বলেন, "এই স্থবিরতার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার যে অর্থ ব্যয় করে, তার ফলে বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি এসব প্রকল্প অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য মাল্টিপ্লায়ার প্রভাব সৃষ্টি করে।"
কোথায় কত ব্যয়
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, যা ছিল বরাদ্দের ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
জুলাই-নভেম্বর সময়ে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান খাতে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ১১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যা ছিল ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে মোট বরাদ্দের ৭৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। মূলত এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের ওপর সামগ্রিক এডিপি বাস্তবায়ন নির্ভর করে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে প্রথম পাঁচ মাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের বাস্তবায়ন হার ছিল ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। একই সময়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় বরাদ্দের ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ব্যয় করেছে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।
অন্যদিকে, সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি ২৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন হার ছিল ২১ শতাংশ। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০ দশমিক ১০ শতাংশ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১৭ দশমিক ০৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে।
এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নগতির প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনা কমিশন এডিপি সংশোধন করে আকার কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির আকার নির্ধারণ করে অর্থ বিভাগ ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনকে চিঠি দিয়েছে।
প্রস্তাবে সরকারি তহবিল ও বৈদেশিক ঋণ অংশ মিলিয়ে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকায় নামানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান অংশের বরাদ্দ ৮৬ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭২ হাজার কোটি টাকায় নামানোর প্রস্তাব রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপির আকার চূড়ান্ত করা হবে।
