বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ‘সেশনজট’

সময়মতো ক্লাস, পরীক্ষা ও ফলাফল না হলে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয় 'সেশনজট', তেমনি দীর্ঘদিন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে 'সেশনজট'।
দলটির বেশ কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মিত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক কমে আসত। এতে দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়াও হতো সহজ। তাদের মতে, নিয়মিত নির্বাচনে প্রার্থীদের সামর্থ্য, সক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যাচাই হতো, যা এখন আর সম্ভব নয়। এতে অযোগ্য বা অনুপ্রাণহীন প্রার্থীরা ছিটকে যেতেন, প্রবীণ নেতারা ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতেন। কিন্তু বিগত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি বর্জন করায় তা হয়নি। ফলে প্রবীণ ও তরুণ—উভয় শ্রেণির নেতারাই এবার মনোনয়নের প্রত্যাশী, এতে দলে তৈরি হয়েছে 'মনোনয়ন সেশনজট'।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণানুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপির প্রত্যেক আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন—কিছু আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন পর্যন্ত। দলীয় সূত্র জানায়, ৩০০ আসনের বিপরীতে এবার দুই হাজারের বেশি প্রার্থী মনোনয়নের প্রত্যাশা করছেন।
বিএনপি নেতারা বলেন, 'গত সরকারের আমলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সুযোগ ছিল না। আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন তরুণ নেতৃত্ব উঠে এসেছে, যারা এখন জনপ্রিয় ও প্রতিশ্রুতিশীল। একই সঙ্গে অনেক অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিবিদও রয়েছেন, যারা অতীতে সংসদে ছিলেন ও দলে কঠিন সময়ে টিকে আছেন। এই দুই প্রজন্মের নেতৃত্বের মিশ্রণেই দলে মনোনয়ন জট তৈরি হয়েছে।'
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দেশে আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে, ২০১৮ সালে অংশ নিলেও সহিংসতা ও নির্যাতনের কারণে মাঠে টিকে থাকতে পারেনি। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও দলটি বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কারণে প্রার্থীদের সক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ আর পাওয়া যায়নি।
তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ২,০৬৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র কেনেন, তবে জামানত জমা দেন ১,১২৩ জন। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে রেকর্ড ৪,৫৮০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে দলটি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'দীর্ঘ ১৭ বছর আন্দোলনে ছিলাম, আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা উপেক্ষা করে দলে টিকে আছি। সবাই নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয়, তাই মনোনয়ন চাওয়া স্বাভাবিক। একই আসনে একাধিক প্রার্থী থাকা দলের ক্ষতি নয়, বরং এটি ইতিবাচক লক্ষণ।'
তবে আসনভিত্তিক একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা হলে কোন্দল ও গ্রুপিং বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কাও রয়েছে। অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন বলেও মনে করছে দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনো অনেক আসনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। তবে চলতি মাসের মধ্যে অধিকাংশ আসনে একক প্রার্থীকে 'গ্রিন সিগন্যাল' দিতে চায় বিএনপি। তফসিল ঘোষণার পরই প্রার্থী ও জোট–আসন বণ্টনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। জোট বা সমমনাদের আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়ও চূড়ান্ত হবে তফসিল ঘোষণা হলে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বিএনপি একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক ও উদার রাজনৈতিক দল। প্রত্যেক আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন—কিছু আসনে ১০ থেকে ১২ জন পর্যন্ত। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাছাই প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। শিগগিরই একক প্রার্থীকে মাঠে কাজের জন্য গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে।'
এদিকে তৃণমূলের নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, একক প্রার্থী চূড়ান্ত হলে অনেক জায়গায় দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং বেড়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কায় নড়েচড়ে বসেছে দলীয় হাইকমান্ড। অভ্যন্তরীণ কোন্দল দমন করতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বিএনপি। নির্দেশনা অমান্য করলে শাস্তিমূলক দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।