ডাকসু নির্বাচনের ২৮ দিন, 'শূন্য তহবিল' নিয়ে কতটুকু কাজ করলেন নেতারা?

গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক বছর মেয়াদি এই সংসদের প্রায় এক মাস পার হচ্ছে। এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে হাঁটছেন ডাকসু নেতারা। তবে নির্বাচনের এক মাস পেরোলেও এখনো গঠিত হয়নি আলাদা কোনো তহবিল। ফলে কাগজ-কলম কেনা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠান আয়োজন—সবকিছুই চলছে ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর স্পনসরশিপের ভরসায়। তাই প্রশ্ন উঠছে, 'শূন্য তহবিল' নিয়েই এ কয়দিনে কতটুকু কাজ করলেন ডাকসু নেতারা।
টাকা নেই ডাকসুর তহবিলে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ডাকসু ও হল সংসদের ফি হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট ফি আদায় করা হয়। তবে ডাকসুর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। তাই যে টাকা ডাকসুর নামে নেওয়া হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটে নিজস্ব আয় হিসেবে ধরা হয়। নির্বাচনের এক মাস পেরিয়ে গেলেও ডাকসুর জন্য এখনো আলাদা কোনো তহবিল তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য রায়হান উদ্দীন দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ডাকসুর ফান্ডে কোনো টাকাই নেই। আমরা যে কাজগুলো এখন পর্যন্ত করেছি, তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) মাধ্যমে বা স্পনসরশিপের মাধ্যমে। এখন প্রত্যেক সম্পাদক কাজের পরিকল্পনা ও এক্সপেক্টেড বাজেটের জন্য ভিপি-জিএস বরাবর আবেদন করেছি।
ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এইচ এম মোশারফ হোসেন বলেন, 'খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। আমি দায়িত্ব নিয়েছি, কমফোর্টেবলি চালাবো, সেখানে আমার কলম–কাগজ কেনার টাকা নেই। সব আমার পকেট থেকে দিয়ে চালাতে হচ্ছে। কাল আবরার ফাহাদের স্মরণসভা অনুষ্ঠানের জন্য কনফারেন্স হলের ভাড়া আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে ধার করে পরিশোধ করেছি। এখন আপাতত শুধু নিয়মিত খরচের জন্য এক লাখ টাকা দ্রুত বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি।'
তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত ডাকসু যা কাজ করছে, তা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ও ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।'
দায়িত্ব নেওয়ার পর ডাকসুর কার্যক্রম
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর ডাকসুর কার্যক্রম নিয়ে ভিপি ও একাধিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মোটাদাগে পরিবহনের ক্ষেত্রে 'বাস ট্র্যাক অ্যাপ' পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা, শাটল সার্ভিসের কলেবর বৃদ্ধি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়ন, প্রতি মাসে একটি করে মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছেন ডাকসু নেতারা।
ডাকসুর ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আব্দুল্লাহ দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ''পূজার ছুটির পর 'আমাদের লাল বাস' নামে বাস ট্র্যাকিং অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে চলবে। এ সময়ে আমাদের ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট রিকশা চলাচলের আরেকটা প্রজেক্ট চালু হবে। এক্ষেত্রে রিকশাচালকদের নির্দিষ্ট পোশাক থাকবে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশা চলবে। বাইরের রিকশা ভেতরে আসবে না।'
তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ১২টি শাটল চলছে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে আরও ২০টি শাটল গাড়ি নিয়ে আসার। বিভিন্ন ডোনারের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা রাজিও হয়েছে। শীঘ্রই এটা চালু হবে।
ডাকসুর স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এম এম আল মিনহাজ দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তুরস্কের এনজিও 'টিকা'র সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়নের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এখানে একটা মডেল ফার্মেসি হবে। পাশাপাশি সব প্যাথলজি টেস্ট এখানে করা যাবে। সরঞ্জামও এনজিওটি দেবে।
তিনি জানান, এছাড়া প্রত্যেক মাসে ইবনে সিনা ট্রাস্টের সহায়তায় একটি করে মেডিকেল ক্যাম্প চলবে। এটা ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (বিজিএইচআরআই) সহায়তায় পূজার বন্ধ শেষ হলেই প্রতিটি হলে ১০০ জনকে ফার্স্ট এইড ট্রেনিং করানো হবে। ছাড়পোকা নিধনে একটি ফার্মের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। হল সংসদের সমন্বয়ে এ কাজ করা হবে।
ইবনে সিনা হাসপাতালের সব টেস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ শতাংশ ছাড়ের বিষয়টিও এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর হবে বলেও জানান ডাকসুর এই নেতা।
দীর্ঘদিনের স্থবিরতার প্রভাব কার্যক্রমে
ডাকসু নেতারা বলছেন, প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘদিন কার্যকর কাঠামো না থাকায় শুরুতে জটিলতায় পড়তে হয়েছে তাদের। এছাড়া অনেক বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত বিষয় জড়িত থাকায় বাস্তবায়নে সময় লাগছে।
ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এখানে একটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অন্য ডিপার্টমেন্টের সমন্বয় নেই। আমরা কোনো কাঠামোই পাইনি। তাই শুরুতেই স্ট্রাকচারটা গুছিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনদের সঙ্গে বসেছি। প্রশাসনকে চাপ দেওয়া এবং প্রতিটি জায়গা 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' আনার চেষ্টা করছি।'
'ইশতেহারে যা আছে, সব ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে আমরা প্রশাসনের কাছে বাজেট জমা দিয়েছি', যোগ করেন তিনি।
মৌলিক সমস্যার অগ্রগতি হয়নি এখনো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারের পুষ্টিমান নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বেশির ভাগ হলে রান্না হয় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও নেই। খাবারের মান বাড়াতে প্রশাসনের কোনো ভর্তুকিও নেই। এমনকি হল সংসদ নির্বাচনের পরেও হলগুলোতে খাবারের মান তেমন বাড়েনি। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বলছেন, কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তামিম আল রাজী বলেন, 'হলের ক্যান্টিনের খাবারের মান আগের মতোই আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি।'
ডাকসুর সদস্য রায়হান উদ্দীন বলেন, সব হলে পুষ্টিবিদের সহায়তায় খাবারের মেন্যু তৈরি করব আমরা। যে মেন্যুতে খাবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, আবার একইসঙ্গে খাবারের মূল্য নাগালের মধ্যে থাকবে। এটা পূজার ছুটির পরই করা হবে।
তিনি বলেন, এছাড়া ক্যান্টিনে তদারকির জন্য একজন নির্দিষ্ট শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হবে। আমাদের পাশে বুয়েটের ক্যান্টিনের কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনভুক্ত। এ প্রস্তাবনাটাও প্রশাসনকে দেব, যা এক ধরনের ভর্তুকির মতো কাজ করবে। আর এতে খাবারের মান বাড়বে বলেও প্রত্যাশা করেন এই ছাত্রনেতা।