খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে খসড়া আইনে ৮০% কৃষিজমি সংরক্ষণের প্রস্তাব

সরকার একটি নতুন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করেছে, যেখানে দেশের বিদ্যমান কৃষিজমির ৮০ শতাংশ শুধুমাত্র কৃষি কাজের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং সরকারি কঠোর অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
'ভূমি ব্যবহার ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫' শীর্ষক এই খসড়ার লক্ষ্য হলো, দেশে ক্রমশ কমে যাওয়া কৃষিজমি যেন আবাসন, শিল্প বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত না হয় তা নিশ্চিত করা।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ আইন দেশের সব ধরনের জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেবে।
ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কৃষিজমি দ্রুতগতিতে অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা খাদ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশ ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা অনেক। তাই কৃষিজমি রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আইন নিশ্চিত করবে, কৃষিজমি যদি আবাসন বা শিল্পায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় হয়।'
তিনি জানিয়েছেন, কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য কিছু বিধান আগেই রয়েছে, তবে তা অসম্পূর্ণ। তিনি বলেন, 'এই আইন কৃষিজমি ব্যবহারে পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করবে এবং অন্যান্য জমির পরিকল্পিত ব্যবহারও নিশ্চিত করবে।'
উপদেষ্টা কমিটি ৬ অক্টোবর খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য বৈঠক করবে। আলী ইমাম বলেন, 'এটি একটি সংবেদনশীল বিষয়। কত দফা আলোচনার প্রয়োজন হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা দ্রুত খসড়াটি চূড়ান্ত করতে চাই এবং নভেম্বরের মধ্যে আইন করার লক্ষ্য নিয়েছি।'
এদিকে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, কৃষিজমি যাতে কোনো অবস্থাতেই অপব্যবহার না হয়, সে জন্য সরকার কঠোর নিয়মসহ এ অধ্যাদেশ করবে।
তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ফসলি জমি কোনো অবস্থাতেই নষ্ট করা যাবে না। এমনকি দ্বি-ফসলি ও ত্রি-ফসলি জমিতেও কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।'
১৪ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ বলেন, দেশের মোট জমির ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ বর্তমানে কৃষিজমি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ রয়েছে।
তিনি আরও জানান, ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ জমি বনভূমি এবং ২০ শতাংশ জমি জলাভূমি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ। তিনি বলেন, 'এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করতে ভূমি জোনিং ও কৃষিজমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ অত্যন্ত জরুরি।'
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০২৪ সালের কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, দেশে মোট কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৮৮ দশমিক ২৯ লাখ হেক্টর।
জোনিং ও সুরক্ষায় নতুন কর্তৃপক্ষ
প্রস্তাবিত আইনে 'কৃষিজমি' বলতে বোঝানো হয়েছে সব ধরনের চাষযোগ্য জমি, তা বর্তমানে চাষ করা হোক বা না হোক— পাশাপাশি মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, প্রাণিসম্পদ পালন বা মাছ চাষের জমিও এতে অন্তর্ভুক্ত।
খসড়া আইনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে এবং কৃষিজমি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে।
খসড়া অনুযায়ী, সরকার 'বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ' গঠন করবে, যা কৃষিজমি সুরক্ষা এবং পরিকল্পিত জোনভিত্তিক ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
ড্রোনসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষ মৌজা ভিত্তিক ভূমির বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করবে এবং সেই অনুযায়ী জোন নির্ধারণ করবে। একবার জোনিং ম্যাপ (মানচিত্র) তৈরি হলে তা ৩০ দিনের জন্য প্রকাশ করা হবে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা জেলা প্রশাসকের কাছে যুক্তিসহ আপত্তি জানাতে পারবেন।
আইনে জমির ওপরের স্তর নষ্ট করা, যেমন ইটভাটায় ব্যবহার বা পাহাড় ও বন কেটে ফেলা নিষিদ্ধ থাকবে। এছাড়া জলাভূমি, নদী, খাল, হাওর ও বনভূমির মতো অকৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত করাও নিষিদ্ধ হবে।
আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জমির ওপরের স্তর নষ্ট করা ঠেকাতে না পারলে বা কৃষিজমি রক্ষায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মানলে শাস্তি পেতে হবে।
অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তি দ্বিগুণ হয়ে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বা হাউজিং সোসাইটিগুলো অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমিতে আবাসিক প্রকল্প গড়তে পারবে না। এ ধরনের প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি দখল করলেও শাস্তি হতে পারে।
কোনো কোম্পানি, এনজিও বা ব্যক্তি যদি অবৈধভাবে কৃষিজমি বাণিজ্যিক বা বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহার করে, তবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। একই অপরাধ পুনরায় করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে, জরিমানা বাড়বে এক কোটি টাকা পর্যন্ত।
অননুমোদিত স্থাপনা ভেঙে ফেলা এবং বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি নিলামে বিক্রির ক্ষমতা থাকবে কর্তৃপক্ষের।
বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল লতিফ এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার সব পক্ষের জন্যই উপকারী হবে।
তিনি বলেন, 'খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, আর কারখানা, রিসোর্ট, পার্কের মতো অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ হবে।'
১৪ ধরনের জমিকে আলাদা জোনে ভাগ করা হবে
খসড়া আইনে জমিকে ১৪টি শ্রেণিতে ভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে— কৃষি, কৃষি-মৎস্য মিশ্র অঞ্চল, নদী-খাল, জলাভূমি, পরিবহন ও যোগাযোগ, শহুরে আবাসিক, গ্রামীণ বসতি, মিশ্র ব্যবহার, বাণিজ্যিক, শিল্প, প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক সুবিধা, বন ও বৃক্ষরোপণ, সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য এবং পাহাড়ি অঞ্চল।
কৃষিজমির মধ্যে ধানক্ষেত, বাগান, গোচারণভূমি ও কৃষি খামার অন্তর্ভুক্ত হবে। মিশ্র ব্যবহার অঞ্চল হবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় উদ্দেশ্যে, আর শিল্প অঞ্চল হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কারখানা মিলিয়ে।
নাগরিক সুবিধার অঞ্চলে থাকবে স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও সরকারি ভবন। বনাঞ্চলে সংরক্ষিত বন, কমিউনিটি বনভূমি ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সংরক্ষিত থাকবে।
কৃষিজমির ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার বা শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে অকৃষিজমি কৃষিকাজে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।
কৃষিজমিকে ফসলভিত্তিক ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে— এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি, চার ফসলি, উদ্যান ফসলি ও মাঠ ফসলি জমি। খাল, জলাধার ও জলাভূমি বিদ্যমান আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
বছরে দুই বা তার বেশি ফসল উৎপাদনকারী জমি কোনো অবস্থাতেই কৃষি ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না, আর এক ফসলি জমিও কৃষির জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব বা জনস্বার্থে ন্যূনতম পরিমাণ এক ফসলি জমি উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তা, স্কুল, শিল্প বা কৃষি-ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারি বা বেসরকারি খাতে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
জমির মালিকরা ন্যূনতম পরিমাণ কৃষিজমি ব্যবহার করতে পারবেন বসতবাড়ি, উপাসনালয়, পারিবারিক পুকুর, দোকান, গুদামঘর, ছোট শিল্প, কবরস্থান বা বসতবাড়িসংশ্লিষ্ট স্থাপনা নির্মাণে। এর বাইরে ব্যবহার করতে হলে অনুমোদন নিতে হবে।
আইনে ন্যূনতম জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইন প্রণয়নের সময় এটি নির্ধারণ করা হবে এবং জমির ধরণভিত্তিক সর্বোচ্চ সীমাও ঠিক করা হবে।
বন, জলাভূমি, নদী, পাহাড় বা উপকূলীয় জমির রূপান্তর অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার জোনিং ম্যাপের ভিত্তিতে 'বিশেষ কৃষি অঞ্চল' ঘোষণা করতে পারবে।
কোনো জমিতে জ্বালানি, খনিজ বা প্রত্নসম্পদ থাকলে সরকার তা অনুসন্ধান বা উত্তোলন করতে পারবে, তবে আগে ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খসড়াটি আগেই উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেখান থেকে কৃষিজমি সুরক্ষায় আরও কঠোর ব্যবস্থা যুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।