সরকারি পরিসংখ্যানে বাড়ন্ত কৃষিজমি, কিন্তু বাস্তবে এসব জমি কোথায়?

২০১৪-১৫ বছরে গাজীপুরে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার একর। অথচ সরকারি তথ্যমতে, ২০২১-২২ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১ হাজার একর। বিষয়টি বিস্ময়কর, কারণ এই সময়েই গাজীপুরে রিসোর্ট ও কারখানার দাপটে কৃষিজমি দ্রুত হারিয়ে গেছে।
এটা গাজীপুর—বাংলাদেশের শিল্পখাতের 'ইঞ্জিন রুম'। এখানে পোশাক কারখানাগুলো প্রায় রাতারাতি গজিয়ে ওঠে, আর ঢাকার ক্লান্ত মানুষদের জন্য রিসোর্ট হয়ে ওঠে সাপ্তাহিক অবকাশ কাটানোর আশ্রয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কারখানা আর রিসোর্টের সারি ধীরে ধীরে স্থান দখল করেছে সেসব ধান ও পাটের মাঠ, যা একসময় এই অঞ্চলের চিরচেনা দৃশ্য ছিল।
তবু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, কৃষিজমি বেড়েছে—কমেনি।
ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী আর মানিকগঞ্জেও দেখা যাচ্ছে একই প্রবণতা। অথচ চোখে দেখা জমির ক্ষয় সরকারি তথ্যের সঙ্গে মেলে না। ফরিদপুরে চিত্র আরও অদ্ভুত—বিবিএস বলছে, সাত বছরে সেখানে কৃষিজমি বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার একর, যদিও নদীভাঙনে অনেক এলাকা বিলীন হয়ে গেছে।
তাহলে এই বাড়তি জমি এলো কোথা থেকে? নদী কি পথ বদলে উর্বর জমি রেখে গেছে? চর কি হঠাৎই বেড়ে গেছে? না-কি কিছু তথ্য আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না—বা যা দেখছি, সেটা বাস্তবের চেয়ে বেশি? সরেজমিনে গেলে সংখ্যাগুলো কিন্তু অন্য গল্প বলছে।
চালের উদ্বৃত্ত বনাম আমদানি: একটি বিপরীত ছবি
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি টনেরও বেশি। যা প্রতিদিন জনপ্রতি ৬৩০ গ্রাম চাল সরবরাহের জন্য যথেষ্ট। অথচ ২০২২ সালে মাথাপিছু চাল খাওয়ার পরিমাণ নেমে এসেছে ৩২৮.৯ গ্রামে, যা উদ্বৃত্ত চালের ইঙ্গিত দেয়।
তবুও সরকার ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫০ হাজার টন এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য আরও ৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে বেসরকারিভাবে আরও ১৪ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উঠে—যদি উৎপাদন যথেষ্ট হয়, আমদানি করার প্রয়োজন কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, হয় তথ্য অসম্পূর্ণ, নয়তো জনসংখ্যার হিসাব যথাযথ নয়।
তবে সব চাল মানুষের খাওয়ার জন্য ব্যবহার হয় না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের ৩১ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট উৎপাদনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ—প্রায় ৩৫ লাখ টন—চলে যায় পশুখাদ্যে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান জানিয়েছেন, বীজ, পশু-পাখির খাদ্য, অপচয় ও ক্ষতির কারণে মোট উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। তবুও, সব সংখ্যার মিল পাওয়া যায় না।
ডিএই বনাম বিবিএস: দুই সূত্রে ভিন্ন তথ্য
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে গাজীপুরে ২১ হাজার ৬৯৪ একর কৃষিজমি কমে গেছে। কিন্তু বিবিএস বলছে, এই সময় কৃষিজমি বরং বেড়েছে।
ফরিদপুরের ডিএই কর্মকর্তারাও বিবিএসের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের দাবি—নদীভাঙনে জমি হারানোর হার নতুন চর গঠনের তুলনায় অনেক বেশি। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এই বিভ্রান্তি স্বীকার করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে কর্মকর্তা রয়েছে। তাই অধিদপ্তরের সহায়তা ছাড়াই জরিপ পরিচালনা করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিবিএস নিজস্ব জরিপ চালায়, ডিএই-ও আলাদাভাবে জরিপ করে। তবে তিনি জানান, 'বিবিএস, ডিএই ও স্পারসো মিলে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি আছে, যারা কৃষিজমি ও উৎপাদনসংক্রান্ত চূড়ান্ত তথ্য নির্ধারণ করে।'
বিবিএসের কৃষি শাখার পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদও নিশ্চিত করেন, তারা স্বতন্ত্রভাবে কৃষি জরিপ পরিচালনা করেন।
নীতিগত ঝুঁকির সতর্কতা বিশেষজ্ঞদের
তথ্যগত এই গড়মিল খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'জনসংখ্যা ও উৎপাদনের সঠিক তথ্য অত্যন্ত জরুরি।' বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যকে 'নীতি নির্ধারণের অক্সিজেন' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব সংস্কার আনতে চায়, তা কার্যকর করতে নির্ভরযোগ্য তথ্য অপরিহার্য। সঠিক সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যানের বিষয় নয়—এটা দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।'
কারণ, শেষ পর্যন্ত—আপনি যা মাপতে পারবেন না, তা ঠিক করবেন কীভাবে?
বিবিএস পুনর্গঠনে নতুন উদ্যোগ
গত সপ্তাহে সরকার বিবিএসের তথ্যের মানোন্নয়নে আট সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করেছে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের (পিপিআরসি) নেতৃত্বে এই কমিটিতে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদরা। তাদের মূল দায়িত্ব হবে তথ্যের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ড. জিল্লুর বলেন, 'আমরা বিবিএস কীভাবে তথ্য তৈরি করে, তাদের প্রতিষ্ঠানগত সক্ষমতা ও সার্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা—সব কিছু বিশ্লেষণ করব।'
তিনি জানান, এই টাস্কফোর্স বিভিন্ন অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।