সৈয়দপুর থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫০ শতাংশ কমে গেছে

ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় নীলফামারীর বাণিজ্যিক উপজেলা সৈয়দপুরের ঝুটভিত্তিক পোশাক ব্যবসায় বড় প্রভাব পড়েছে।
সৈয়দপুর এক্সপোর্টেবল স্মল গার্মেন্টস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইএসজিওএ) জানিয়েছে, ঝুট থেকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি সংকটে পড়ছে, কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন অনেকেই।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সমুদ্রপথে রপ্তানি কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তিনগুণ, আর পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগছে ২০ থেকে ২৫ দিন। এ পরিস্থিতি সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
ঐতিহ্যবাহী শিল্পে টানাপোড়েন
সৈয়দপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। কে প্রথম শুরু করেছিলেন, তা নিশ্চিত নয়। তবে শুরু থেকেই ঝুট থেকে তৈরি হয়ে আসছে নানা ধরনের পোশাক। ২০০২ সাল থেকে এর বিস্তার আরও বাড়তে থাকে।
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার পোশাক কারখানা থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি সুতা, বোতাম, ইলাস্টিক, প্যান্টের পকেটের স্টিকার, পুরোনো সেলাই মেশিনও সংগ্রহ করা হয়।
এসব দিয়ে তৈরি হয় ট্রাউজার, শর্টস, জ্যাকেট, টি-শার্ট, জিনসসহ বিভিন্ন পোশাক। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, এসব পোশাকের চাহিদা বাংলাদেশে যতটা, তার চেয়ে বেশি ভারত, নেপাল ও ভুটানে।
বর্তমানে অন্তত ৫০০ পরিবার সরাসরি এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সৈয়দপুরের প্রায় প্রতিটি বাড়িই এখন ছোট পোশাক কারখানায় পরিণত হয়েছে। কোথাও ২টি, কোথাও আবার ৪৫টি মেশিনে সারা বছর কাজ চলছে। উৎপাদিত পোশাক দেশের বাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারেও।
তবে ভারত সরকারের সাম্প্রতিক স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-নিষেধাজ্ঞার কারণে উৎপাদন প্রায় থমকে গেছে। এতে শত শত পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

রপ্তানির পথ বন্ধ, খরচ বেড়েছে তিনগুণ
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৭ মে এক আদেশে জানায়, তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এখন থেকে কেবল কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়েই আমদানি করা যাবে।
ব্যবসায়ীরা জানান, আগে সৈয়দপুর থেকে বেনাপোল, সোনামসজিদ ও সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক রপ্তানি করা হতো। আগে যে পরিমাণ পোশাক ভারতে রপ্তানিতে খরচ হতো ২০ হাজার টাকা, এখন কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তা রপ্তানির খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার। অর্থাৎ পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তিনগুণ। ফলে অনেক ব্যবসায়ী এখন ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছেন, শুধু বাজারে টিকে থাকার জন্য।
উদ্যোক্তাদের ওপর ধাক্কা
সৈয়দপুর থেকে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইনভেন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক হুমায়ুন কবির ৩২ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
তিনি বলেন, "আমরা সাধারণত ঝুট কাপড়ের তৈরি ট্রাউজার, জ্যাকেট ও শর্টস রপ্তানি করি। পাবনায় আমাদের একটি কারখানা আছে, যেখানে মূলত টিশার্ট তৈরি হয়। সব মিলিয়ে বছরে অন্তত ৫ কোটি টাকার পোশাক ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করতাম।"
তিনি আরও বলেন, "কিন্তু ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন স্থলপথে কোনো পণ্য রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রায় শতভাগই ভারতে যায়। এখন কেবল কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাচ্ছে। এতে খরচ বেড়েছে অন্তত তিনগুণ, সময় ও ভোগান্তিও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের রপ্তানি অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।"
এইচআর গার্মেন্টসে ঝুট থেকে জ্যাকেট, ট্রাউজার ও শর্টস তৈরি হয়। প্রায় এক দশক ধরে এ কারখানায় রপ্তানিযোগ্য পোশাক উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মো. সুজন আলী বলেন, "গত এক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ। এর কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।"
"আগে স্থলবন্দর দিয়ে দুই দিনেই পণ্য পৌঁছে যেত ভারতে, এখন লাগছে ২০-২৫ দিন। আমরা এই দুঃখের কথা কাকে বলব?," বলেন তিনি।
আরেক রপ্তানিকারক ফরহাদ হোসেন বলেন, "রপ্তানি ব্যবসায় এটি আমাদের জন্য বড় ধাক্কা। অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। কর্মচাঞ্চল্যে ভরা পরিবেশ এখন স্থবির হয়ে পড়েছে শুধু স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে।"
এখানকার ছয়জন বড় ব্যবসায়ী, যারা নিয়মিত ভারত রপ্তানি করতেন, জানিয়েছেন—প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার পোশাক ভারতে রপ্তানি হতো।
স্থানীয় অর্থনীতিতে ধাক্কা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে প্রায় ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা।
ভারত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বড় বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশই যায় স্থলপথে। ফলে নতুন নিষেধাজ্ঞা গার্মেন্টস খাতে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।
সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক শিল্প সমিতির সহসভাপতি আরশাদ আমির পাপ্পু বলেন, "সৈয়দপুরের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে আছে শত শত কারখানা। এখানে ঝুট কাপড় থেকে নানা ধরনের পোশাক তৈরি হয়, যার কিছু ভারতে যায়। কিন্তু ভারত সরকারের স্থলবন্দর সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা এ শিল্পকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন।"
"বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুই দেশের সরকারকেই ভাবতে হবে। সংকট সমাধান হলে তবেই সৈয়দপুরের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে," যোগ করেন তিনি।