বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহ যশোরের মণিহার, হল ভেঙে বানানো হবে মার্কেট-আবাসিক হোটেল

দেশের বৃহত্তম সিনেমা হল যশোরের মণিহার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হলটি ভেঙে সেখানে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে তৈরি হতে পারে সিনেপ্লেক্সও, তবে তা অনুমোদন সাপেক্ষে বলে জানা গেছে।
ভালো সিনেমার অভাব ও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ একসময় মণিহার ছিল এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম একক পর্দার সিনেমা হল।
এ প্রেক্ষাগৃহকে ঘিরে দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে গত এক দশকে নানা কারণে প্রেক্ষাগৃহমুখী দর্শক কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ব্যর্থতার দায় শুধু মণিহারের নয়, এটি দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ভঙ্গুর অবস্থার প্রতিফলন।
চলচ্চিত্রশিল্পের নানা সীমাবদ্ধতা মোকাবিলা করে দীর্ঘদিন টিকে থাকার চেষ্টা করেছে মণিহার। ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি সমন্বিত পদক্ষেপও প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
১৯৮২ সালে যশোরের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম এ প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের ঘোষণা দেন। পত্রিকার মাধ্যমে নাম আহ্বান করলে তিনি কয়েকশ প্রস্তাবের মধ্যে 'মণিহার' নামটি বেছে নেন। যশোর শহরের সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে চার বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ প্রেক্ষাগৃহটি তৈরি হতে সময় লাগে দেড় বছর।
হলের আসন সংখ্যা ছিল ১,৪৩০। নকশা করেন ঢাকার স্থপতি কাজী মোহাম্মদ হানিফ। নির্মাণ-পরবর্তী সাজসজ্জার কাজ করেন শিল্পী এস এম সুলতান। আধুনিক নকশা ও বৈচিত্র্যময় স্থাপত্যশৈলীর কারণে দেশজুড়ে সুনাম পায় এ প্রেক্ষাগৃহ।
চারতলা ভবনের পুরো প্রেক্ষাগৃহ ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। র্যাম সিঁড়ি, ঝরনা, ঝাড়বাতি ও বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছিল অভ্যন্তর। ভালোমানের সিনেমা প্রদর্শনের নীতিতে ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে মণিহার। নিয়মিত দর্শক ও মানসম্পন্ন পরিবেশের কারণে একসময় ঢাকার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো এটি।
উদ্বোধনের পর মণিহারে প্রথম প্রদর্শিত হয় দেওয়ান নজরুল পরিচালিত সোহেল রানা ও সুচরিতা অভিনীত চলচ্চিত্র 'জনি'। এরপর এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত সিনেমা তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত 'বেদের মেয়ে জোসনা'। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমা টানা তিন মাস দিনে চারটি শো হাউসফুল ছিল।
এছাড়া মনপুরা, আয়নাবাজি, যদি একদিন, হাওয়া ও পরাণ–এর মতো ব্যবসাসফল ছবিও মণিহারে সর্বাধিক দর্শক টেনেছে।
হলটিতে প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা, বেলা সাড়ে ৩টা, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা ও রাত সাড়ে ৯টায় চারটি শো প্রদর্শিত হতো। ১৯৮৩ সালে টিকিটের দাম ছিল নিচতলায় ৫ ও ১০ টাকা এবং দ্বিতীয় তলায় ১৫ টাকা। বর্তমানে নিচতলায় ১০০ টাকা এবং এসি-সুবিধাযুক্ত দ্বিতীয় তলায় ১৫০ টাকা।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সেলুলয়েড ফিল্ম রিলের মাধ্যমে সিনেমা দেখানো হতো। এরপর থেকে 'ডিজিটাল সিনে সার্ভিস'–এর মাধ্যমে উন্নত মানের লেজার প্রজেক্টরে ডিজিটাল সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে, যা সিনেপ্লেক্স বাদে দেশের অন্য কোনো হলে নেই।
মণিহার সিনেমা হলের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ইসলামের ছেলে ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, "শুধু ব্যবসার জন্য নয়, বাবার শৈল্পিক মন থেকে মণিহার নির্মিত হয়েছিল। যশোরের মানুষের বিনোদনের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। একসময় সেই স্বপ্নই মণিহারকে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা হলে পরিণত করে।"
তিনি আরও বলেন, "সময়ের বিবর্তনে আমরা হলটি আধুনিকভাবে সাজিয়েছি। তবে সিনেমার প্রাণ দর্শকই এখন নেই। সে কারণে ব্যবসার পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি হল ও মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে, যা পারিবারিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।"
মণিহারের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে জিয়াউল ইসলাম বলেন, "৪২ বছরের ইতিহাসে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে এই হল। ২০১২ সালের ২২ জুলাই সন্ত্রাসী হামলা ও চাঁদাবাজির কারণে হলটি প্রথমবার বন্ধ হয়ে যায়। ২০ দিন পর প্রশাসনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আবার চালু করা হয়। তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং আর্থিক সংকট আরও বেড়েছে।"
ভালো মানের ছবি না আসায় দর্শকহীন হয়ে পড়েছে মণিহার। জিয়াউল ইসলাম বলেন, "এখন তো ছবি নেই। ছবি না থাকলে হল কীভাবে চালাব? এখন কলকাতার অভিমান চালাচ্ছি, যেটা চারবার দেখানো হয়েছে। সিনেপ্লেক্সে চলছে সালমান শাহের বিক্ষোভ। এভাবে তো আর সম্ভব না। তাই আমরা হলটি বন্ধ করার পরিকল্পনা করছি।"
লোকসানের ভার বাড়তে বাড়তে এখন খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মণিহার কর্তৃপক্ষ। হলটি ভেঙে মার্কেট করার প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, "আমাদের সিট সংখ্যা ১,৪৩০টি; স্টাফ ২৫ জন। এভাবে চালানো যায় না। শুধু বিদ্যুৎ বিলই আসে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। তাই সিঙ্গেল হলটি ভেঙে সামনে হয়তো মার্কেট ও আবাসিক হোটেল করব। সিনেপ্লেক্সও হতে পারে। ইতোমধ্যে আর্কিটেক্টকে ডিজাইন করতে দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হবে। তবে তার আগ পর্যন্ত এভাবেই চালাতে হবে।"
কবে নাগাদ হলটি ভাঙা হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয় বলে তিনি জানান। পরিকল্পনা অনুমোদিত হলেই ভাঙার কাজ শুরু হতে পারে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়াও বিবেচনায় রাখা হবে। তিনি বলেন, "হল ভাঙলেও সিনেপ্লেক্স সচল থাকবে।"
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও জানালেন মিঠু। "ভয় হচ্ছে, সামনে হলগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে কি না। আগে টিকিট বিক্রি থেকে খরচ বাদ দিয়ে ভালো মুনাফা থাকত। এখন কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিলই ওঠে না। সরকারি সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভালো মানের সিনেমা তৈরি না হলে সরকারকে আমদানি করেই হলগুলো বাঁচাতে হবে, না হলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।"
মণিহার সিনেমা হলের প্রধান পরিচালক শফিউদ্দীন মিন্টু জানান, "১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমি এই হলে আছি। ২০১২ পর্যন্ত সেলুলয়েড ফিল্ম রিল চালিয়েছি। এরপর থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে ছবি প্রদর্শন করছি। মণিহার আমার রক্তে মিশে আছে। অন্য কোনো কাজের প্রতি মন বসে না।"
তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, "প্রথম দিকে নতুন ছবি এলে ফিল্ম গুছিয়ে রিলে চাকা বানাতে হতো। প্রদর্শনের সময় মেশিনে সব সময় একজন দাঁড়িয়ে থাকত। তখন শারীরিক খাটুনি ছিল, কিন্তু তাতেই আনন্দ পেতাম। এখন চারজনের কাজ একজন করে। কম্পিউটারে সব চালু করে দিয়ে বাইরে চলে যাই।"
হল বন্ধ হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে শফিউদ্দীন বলেন, "ছবির মান ভালো না হওয়ায় দর্শক আসেন না। খারাপ ছবি প্রদর্শনের কারণে দেশের অনেক হলে দর্শক কমেছে। তবে মণিহারে চিত্রনায়িকা শাবনূর ছাড়াও নায়করাজ রাজ্জাক, শাবানা, মান্না, শাকিব খান, রিয়াজ, পূর্ণিমা, প্রবীর মিত্রসহ চলচ্চিত্রাঙ্গনের সবার পদচিহ্ন রয়েছে। আগে নতুন ছবি মুক্তি পেলে শিল্পীরা মণিহারে আসতেন। এ হলটিকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।"
শফিউদ্দীন মিন্টু আক্ষেপ করে বলেন, "১০ বছর আগে প্রতিটি শো দর্শকে ভরা থাকত। তখন আনন্দ লাগত। এখন দর্শক আসেন না, কারণ এই সময়ের সিনেমার কাহিনি ভালো নয়। আগে সিনেমা কাহিনিনির্ভর ছিল। রাজ্জাক-শাবানার আমলে কোনো কান্নার দৃশ্য হলে দর্শক কেঁদে দিতেন। সর্বশেষ আয়নাবাজি ছাড়া কোনো ছবি দর্শকপ্রিয় হয়নি। তবে প্রিয়তমা ভালো চলেছিল।"
"১৯৮৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় সব সিনেমাই ব্যবসাসফল ছিল, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছিল বেদের মেয়ে জোসনা। সাম্প্রতিক সময়ে হাওয়া ছবিও কিছুটা সাফল্য পেয়েছে," যোগ করেন তিনি।
হলের আরেক প্রবীণ কর্মচারী মোল্লা ফারুখ স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন, "মণিহারের ১ হাজার ৪৩০ সিট একসময় সব ভরে যেত। টিকিট না পেয়ে অনেকে ফিরে যেতেন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত আরও এক হলের সমান দর্শক। এখন সব অতীত। আগে সামাজিক সিনেমাই বেশি হতো, পরিবার নিয়ে সবাই আসত। এখন অশ্লীলতার কারণে পরিবার আসে না। তবে ভালো সিনেমা হলে মানুষ অবশ্যই হলমুখী হবে।"
তিনি আরও জানান, মণিহারের সঙ্গে চিত্রনায়িকা শাবানার ভাত দে ছবির অনেক স্মৃতি আছে। সিনেমাটি দেখতে এসে নিজেই কেঁদে ফেলেছিলেন শাবানা।
কর্মচারী আসলাম বলেন, "আগে ছবি মুক্তি পেলে শুক্রবার জায়গা পাওয়া যেত না। এখন শো শুরু হয় ২০ থেকে ২৫ জন নিয়ে, নাইট শো চলে ৫ থেকে ১০ জন দর্শক নিয়ে। কখনো নাইট শো বন্ধও হয়ে যায়। দেশে ভালো মানের ছবি না আসায় হল খারাপ অবস্থায় পড়েছে।"
যশোরের শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "কাহিনি-নির্ভর সামাজিক ছবি নির্মাণ না করায় দর্শক হতাশ হয়ে হল থেকে ফিরছেন। একই ধরনের নকল ছবি প্রদর্শনের কারণে দর্শক দূরে সরে গেছেন। সিনেমা হলগুলোর পরিবেশও নষ্ট হয়েছে। ভদ্র পরিবার সিনেমা হলে যায় না। দর্শক এখন মূলত নিম্নবিত্তের মানুষ। সুস্থধারার বিনোদন ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।"