রাজশাহীর পাহাড়িয়াদের ৫৩ বছরের বসতি 'উচ্ছেদ' ও ‘বিদায়ী খাসি ভোজ’ আপাতত স্থগিত, তদন্তে প্রশাসন
শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় একটি খাসি জবাই করে ভোজের আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। তবে এই আয়োজন কোনো উৎসবের জন্য নয়, ছিল ৫৩ বছরের বসতি থেকে 'উচ্ছেদ' হওয়ার আগে ১৩টি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পরিবারের জন্য এক ধরনের 'বিদায়ী ভোজ'। তবে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আপাতত সেই উচ্ছেদ ও ভোজের আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) এ ঘটনায় তদন্তে নেমেছে ভূমি অফিস ও স্থানীয় পুলিশ।
জমির ইতিহাস ও মালিকানার দ্বন্দ্ব
প্রায় ৫৩ বছর ধরে মোল্লাপাড়ার এই জমিতে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বসবাস করে আসছে। সম্প্রতি জমির মালিকানা দাবি করে স্থানীয় সাজ্জাদ আলী তাদের 'উচ্ছেদে তৎপরতা' শুরু করেন। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) মহল্লা ও বাড়ি-ঘর খালি করা হবে, সে উপলক্ষে শুক্রবার খাসি জবাই করে তাদের খাওয়ানোর আয়োজন করেন তিনি।
পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, এই জমির মূল মালিক ছিলেন ইন্দ্রা ধুপি নামের একজন ধোপা। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে আসা ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবারকে তিনি এখানে থাকার অনুমতি দেন। জায়গাটি তখন ইন্দ্রা ধোপার বাগান নামে পরিচিত ছিল। ইন্দ্রা ধোপা নিঃসন্তান ছিলেন।
ভূমি অফিসের আরএস খতিয়ান অনুযায়ী, ৩৭ দশমিক ৯৪ শতক এই জমির মালিক হিসেবে রাজশাহীর কাজীহাটা এলাকার গাজিয়া রজকিনি ও ময়মনসিংহের কোতোয়ালির মনিতারা রজকিনির নাম রয়েছে। কিন্তু ১৯৯৪-৯৫ সালে এই জমি সাজ্জাদ আলী, সৈয়দ আলী, ইমতিয়াজ ও ফাহামিদার নামে খারিজ হয়।
সাজ্জাদ যে দলিল পুলিশকে দেখিয়েছেন, তাতে দেখা যায়—সাজ্জাদ ও অন্যরা জমিটি মধুসূদন দাস, দিলীপ দাস, আমমোক্তার সূর্য কমল দাস, প্রকাস দাস ও তৃপাল রজকের কাছ থেকে কিনেছেন।
ভূমি অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আরএস রেকর্ডে গাজিয়া রজকিনি ও মনিতারা রজকিনির কাছ থেকে সাজ্জাদের কাছে সরাসরি দলিল হলে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু মধুসূদন দাস, দিলীপ দাস, আমমোক্তার সূর্য কমল দাস, প্রকাস দাস ও তৃপাল রজকের নামে জমি কীভাবে হয়েছিল, আগে সে দলিল দরকার। ওই দলিল না পাওয়া গেলে সাজ্জাদের কাছে থাকা দলিল থাকা প্রশ্নবিদ্ধ। এ দলিল সঠিক কি না, সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে।'
তবে সাজ্জাদ আলীর দাবি, ইন্দ্র ধুপি মৃত্যুর আগে এ জমি তার কাছে বিক্রি করে গেছেন।
দুই পক্ষের কথা শুনতে বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা পাহাড়িয়া মহল্লায় যান। ডেকে আনা হয় সাজ্জাদ আলীকেও।
পাড়ার বাসিন্দারা জানান, এটা তাদের জন্মস্থান। তারা সেখানেই থাকতে চান।
আর সাজ্জাদ পুলিশের কাছে দাবি করেন, তার কাছে এই জমির বৈধ দলিল রয়েছে। তিনি নিয়মিত খাজনা দিচ্ছেন। পাড়ার বাসিন্দাদের পুনর্বাসনে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন। প্রথম বাড়ি করা ছয়টি পরিবার ধরে প্রতিটি বাড়িতে ৬ লাখ করে টাকা দিয়েছেন। ছয় পরিবার এখন বেড়ে হয়েছে ১৬টি। মোট ৩০ লাখ টাকা ১৬ পরিবারে ভাগ হয়েছে।
এ বিষয়ে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের বাসিন্দা জরিনা বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, 'আমাদেরকে টাকা দিয়েছে যাতে আমরা কাউকে না বলি। আমাদেরকে জোর করে উচ্ছেদের জন্য টাকা দিয়েছে। কিন্তু আমরা এখান থেকে যেতে চাইনা, আমরা এখানেই থাকতে চাই। কালকে প্রশাসনের লোকজন এসে আমাদের এখানে থাকতে বলে গেছে। আমরা এখানেই থাকবো।'
খাসি জবাই করে খাওয়ার আয়োজনের বিষয়ে সাজ্জাদ বলেন, 'তারা এখানে এতদিন ছিল। চলে যাচ্ছে। আমি তাদের মুরগি খাওয়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারাই বলেছে যে, খাসি খাওয়াতে হবে।'
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী মহানগরেরে সাধারণ সম্পাদক ছোটন সরদার বলেন, 'আমরা চাই আদিবাসীরা এখানেই থাকুক। ৫৩ বছর যে পরিবারগুলো এখানে বসবাস করেছেন, তাদের উচ্ছেদ করা হবে এটা আমরা মানবো না। আমরা চাই প্রশাসন তাদেের এখানে রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে।'
এছাড়াও এ ঘটনায় আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোল্লাপাড়ায় আদিবাসী সংগঠনসহ কয়েকটি সংগঠন উচ্ছেদের প্রতিবাদে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করে। সেখান থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানানো হয়।
মানববন্ধনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার বলেন, 'আদিবাসীদের উচ্ছেদ আমরা মানি না। আদিবাসীরা এখানে আছে তাদের এখানেই রাখতে হবে।'
তদন্তে প্রশাসন
তবে পুলিশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, শুক্রবার কোনো ভোজের আয়োজন হবে না এবং জমির বিষয়টি মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাসিন্দারা সেখানেই থাকবেন।
নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার ওসি আজিজুল বারী সাজ্জাদ বলেন, 'যেটাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, সেটা করব। আপাতত এখানকার বাসিন্দারা এভাবেই থাকবেন। জমির কাগজপত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মহিনুল হাসান বলেন, 'জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা প্রথমে যাচাই করে দেখছি, জমির মালিকানা কার। তারপর অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত আদিবাসীদের সেখানেই থাকতে বলা হয়েছে।'
নগরের বড়কুঠি ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তিনি সার্ভেয়ারকে [ভূমি জরিপকারী] পাঠিয়েছেন। সবকিছু তদন্ত করে একটা প্রতিবেদন দেবেন।
