জাকসু নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন?

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা ধরনের প্রত্যাশা ও আশঙ্কা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আদিবাসী শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, এই নির্বাচন তাদের অধিকার, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ও নিরাপদ শিক্ষাজীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে এবার ২৫ পদের বিপরীতে লড়ছেন মোট ১৭৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে প্রার্থী হয়েছেন ২৬ জন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ নির্বাচনে ১১ হাজার ৯১৯ জন ভোটার তাদের প্রতিনিধিকে বেছে নেবেন।
অন্যদিকে সংখ্যালঘু প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৮ জন, সনাতন ধর্মাবলম্বী ১৩ জন, বৌদ্ধ ৩ জন এবং খ্রিস্টান ২ জন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় শতাধিক আদিবাসী শিক্ষার্থী এবং এক হাজারের বেশি সনাতন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ সীমিতই রয়ে গেছে।
প্যানেলভিত্তিক অবস্থান
এবারের নির্বাচনে মোট আটটি প্যানেল প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন (অদ্রি–অর্ক), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আদিবাসী শিক্ষার্থী পরিষদ) এবং জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট সমর্থিত 'সম্প্রীতির ঐক্য' প্যানেল থেকে লড়ছেন ৭ জন আদিবাসী, ৬ জন সনাতন, ৩ জন বৌদ্ধ ও ২ জন খ্রিস্টান প্রার্থী।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত 'শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম' থেকে লড়ছেন একজন আদিবাসী প্রার্থী। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলে আছেন একজন সনাতন প্রার্থী। আব্দুর রশিদ জিতু–শাকিল আলী সমর্থিত 'স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন' এবং জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থিত 'স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ'—এই দুই প্যানেল থেকেও লড়ছেন দুই জন করে সনাতন প্রার্থী।
তবে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত 'সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট', বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (ইমন–তানজিম) ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সমর্থিত 'সংশপ্তক পর্ষদ' এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) সমর্থিত প্যানেলে নেই কোনো সংখ্যালঘু প্রার্থী।
প্রার্থীদের অভিমত
ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'আদিবাসী শিক্ষার্থীদের প্যানেলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছি। তবে তারা কেউ আগ্রহ দেখাননি।'
অন্যদিকে সংখ্যালঘু প্রার্থীরা বলছেন, সাইবার বুলিং, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও পারিবারিক বিধিনিষেধের কারণে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত।
শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদপ্রার্থী সুকান্ত বর্মণ বলেন, 'আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সবসময় অনলাইনে বিদ্বেষমূলক আক্রমণের শিকার হন। এ কারণেই তাদের অংশগ্রহণ কম।'
নাট্য সম্পাদক পদপ্রার্থী ও আদিবাসী শিক্ষার্থী পরিষদের সভাপতি ইগিমি চাকমা বলেন, 'গত বছর পাহাড়ে হামলার সময় ভুয়া ফেসবুক পেজে আমাকে নিয়মিত গালিগালাজ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অ্যাকাউন্ট ডিলিট করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুরা নির্বাচনে উৎসাহিত হতে পারে না।'
প্রীতিলতা হল সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক পদপ্রার্থী ডলি রাণী রায় বলেন, 'নারী ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি জরুরি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিশ্চিত করতে হবে, ধর্ম বা জাতিসত্তা নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন নিজের দাবি তুলতে পারে।'
আসন্ন জাকসু নির্বাচনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তবে তাদের আলাদা সত্তা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো নীতি-নির্ধারনি জায়গায় তাদের সামগ্রিক অংশগ্রহণ কম।
এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী সোমা ডুমরি বলেন, 'আসন্ন জাকসু নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত মোট ২৫টি পদের মধ্যে ৬টি আসন সংরক্ষিত থাকলেও, আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো সংরক্ষিত আসন। রাষ্ট্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমরা আদিবাসীরা আলাদা সত্তা, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে আমাদের সংকট এবং আকাঙ্ক্ষার জায়গা ভিন্ন।'
তিনি বলেন, 'সে জায়গা থেকে আমাদের প্রশাসন বরাবর আকাঙ্ক্ষা ছিলো, আমাদের জন্য একটি পৃথক সংরক্ষিত আসন প্রশাসন নিশ্চিত করবে, যা প্রশাসন করেনি। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের লড়াই টিকিয়ে রাখার জন্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল আদিবাসী শিক্ষার্থীর সার্বিক স্বার্থে আমরা অনুভব করেছি যে, জাকসুতে আমাদের আদিবাসী প্রতিনিধি থাকাটা জরুরি। এবং এই অপরিহার্য আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীরাও অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করছি নিজেদের অস্তিত্ব এবং সমঅধিকারের নিশ্চয়ের প্রশ্নে।'
বিশেষজ্ঞের মত
নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছরের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোতে প্রধান হিসেবে কখনো আদিবাসী শিক্ষার্থীদের দেখা যায়নি। আদিবাসী সংগঠন ব্যতীত জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, সাংস্কৃতিক জোটসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের দেখা যায়নি। তারা প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত এবং তাদের না দেখার স্বভাব আমাদেরকে তাদেরকে না দেখাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। তাদের ওপর মেইনস্ট্রিমকরণের (মূলধারায় নিয়ে আসা) একটা বাধা রয়েছে। তার ফলেই তাদের বিষয়টা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। যার প্রতিফলন জাকসু নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপেক্ষা করার চলমান প্রক্রিয়া এবং পাওয়ার স্ট্রাকচার ও পলিটিক্যাল স্ট্রাকচারে রাজনৈতিক এজেন্সি ও সম্ভাবনা, যা পুরুষতান্ত্রিক ও প্রথাগত চেতনা দ্বারা আবদ্ধ। বাঙালির জাতীয়তাবাদের দাপটে যেমন আদিবাসীদের দেখা যায় না, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক পেশিশক্তির দাপটে নারীদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ নারী থাকার পরেও নারীরা যেন স্ট্যাটাসে মাইনোরিটি। এই বিষয়গুলো মূলত জাকসু নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে।'