ব্যাংকিং খাতে ১৬ বছরের লুটপাট: বাংলাদেশ ব্যাংক ও ২৬ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার

২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালে এই ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পদের তথ্য তলবসহ তদন্ত শুরু করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশন (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) দুদকের কাছে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর (বিএফআইইউ) প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।
১৯ আগস্ট দুদকের চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে, ডিভিশন ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালি, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এর দায়িত্বে থাকা বোর্ড চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছে। পাশাপাশি, বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি ও অনিয়মে জড়িত ১৮টি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দুদক ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩ জন সাবেক গভর্নর—ডা. আতিউর রহমান, ডা. ফজলে কবীর এবং আবদুর রউফ তালুকদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছে। এছাড়াও ছয়জন সাবেক ডেপুটি গভর্নরের তথ্যও তলব করা হয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই পদক্ষেপটি ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্নীতি রোধ করতে সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ। তারা নিশ্চিত করেছেন, সম্প্রতি পুনর্গঠন বা একীভূতকরণ পরিকল্পনার অংশ থাকা সব বেসরকারি ব্যাংক তদন্তের আওতায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সাক্ষী হয়েছে। এর মধ্যে ছিল হ্যালমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি, ব্যাপক লুটপাট এবং অর্থ পাচার। ব্যাপক ঋণ খেলাপির কারণে বেসিক ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংক ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে ১৮টি বেসরকারি ব্যাংকও পদ্ধতিগত অনিয়মের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের অধীনে থাকা ছয়টি ব্যাংক রয়েছে, এবং আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে লড়াই করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পরে বোর্ড পুনর্গঠন হওয়া ১৫টি বেসরকারি ব্যাংক তদন্তের আওতায় রয়েছে। এগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), আইএফআইসি ব্যাংক, ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি), মেঘনা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (বিসিবিএল) এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক।
তাছাড়া, আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এগুলো হলো—এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ডা. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা পারস্পরিক যোগসাজশ করে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেছে। একটি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আমার ছাত্র। তার কাছে জানতে চাইলাম, ওই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কত। তিনি বললেন, ৯৫ শতাংশ। চেয়ারম্যান, পরিচালক ও মালিকপক্ষ যোগসাজশ করে প্রায় পুরো টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেছে।'