ইলিশের উচ্চমূল্য, কম আহরণ: সংকটে জেলে ও ক্রেতারা

বাংলাদেশের নদীতে একসময় প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যেত। তবে দ্রুতই যেন এ সংখ্যা কমে আসছে। পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় জেলেদের হতাশ হওয়ার পাশাপাশি চড়া দামের বোঝা বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদেরকেও।
লক্ষ্মীপুরের মতিরহাট একসময় ইলিশ বেঁচা-কেনার জমজমাট কেন্দ্র হলেও, এখন তা তার অতীত জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। আগে, ভোর ৬টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত প্রাণচঞ্চল এ হাটে এখন মাছের সরবরাহ এত কম যে ২-৩ ঘণ্টা দোকান খোলা রাখলেই মাছ শেষ হয়ে যায়।
ডুবোচর, নদীর নাব্যতা সংকট ও দূষণের কারণে মেঘনায় ইলিশের বিচরণ কমে যাওয়ায় জেলেরা ট্রলারের তেলের খরচও তুলতে পারছেন না।
স্থানীয় জেলে জুলহাস মাঝি টিবিএসকে বলেন, '১৯০০ টাকার তেল খরচ করে গিয়েছিলাম ইলিশ ধরতে। ছোট ৯টি ইলিশ পেয়েছিলাম, ওজন হবে ২ কেজি। বিক্রি করতে পেরেছি মাত্র ২৩০০ টাকায়। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ ধরি, এমন খারাপ সময় আসেনি।'
জুলাই থেকে অক্টোবর ইলিশের প্রধান মৌসুম হলেও এবছর কাঙ্ক্ষিত সরবরাহ মিলছে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে এক কেজির চেয়ে বড় আকারের ইলিশ কেজিপ্রতি ২২০০-২৬০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির ইলিশ ১৬০০-২২০০ টাকা এবং ৫০০-৮০০ গ্রামের ইলিশ ১০০০-১৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট আকারের জাটকা ৬০০-১০০০ টাকায় মিলছে।
নাব্যতা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, ডুবোচর, দখল-দূষণ, বাঁধ-সেতুসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ইলিশের প্রজনন ও বিচরণে বড় বাধা বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলেরা বলছেন, সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে তেল ও শ্রমিক খরচ মেটানোই কঠিন। হাতিয়ার চরচেঙ্গা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মান্নান রানা জানান, 'একবার ট্রলার পাঠাতে খরচ হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। আগের মতো বড় ঝাঁক ইলিশ আর পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্ণিমা-অমাবস্যার সময়ও এবার মাছ উঠেনি।'
মতিরহাট ঘাটের কয়েকজন আড়তদার জানান, বর্তমানে এক কেজি আকারের নদীর ইলিশ প্রতিকেজিতে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০-২৮০০ টাকায়। আর ৭০০-৮০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০-২০০০ টাকায়। যেখানে কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন ১ টনের বেশি ইলিশ এ হাটে বিক্রি হতো, সেখানে এখন মাত্র গড়ে আড়াইশ থেকে তিনশ কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। একারণে বিক্রেতারা ২-৩ ঘন্টা দোকান খোলা রাখেন।
বরিশালেও একই অবস্থা। পোর্ট রোড বাজারে ইলিশের দামও আকাশছোঁয়া। দেড় কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২৮০০-২৮৫০ টাকায়, এক কেজি সাইজের ২৪৫০-২৫০০ টাকায়, আর ৮০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ১৮৫০-২০০০ টাকায়, ৬০০ গ্রামের ইলিশ প্রতিকেজি ১৫০০-১৫৫০ টাকায়।
বিক্রেতা আব্দুল কাদের বলেন, 'একসময় এ বাজারে হাঁটা যেত না মাছের ভিড়ে। এখন মাছ নেই। নদীর নাব্যতা নষ্ট হয়েছে, ব্রীজ করার কারণে স্রোত কমেছে। জেলেদের জালে মাছ উঠছে না।'
ইলিশ উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আহরণ কমেছে ৪২ হাজার টন। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে আহরণ হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার টন, যা ২০২৩-২৪ সালে নেমে আসে ৫ লাখ ২৯ হাজার টনে।
কেন কমছে ইলিশ?
গবেষকরা বলছেন, জুলাই থেকে অক্টোবরে মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চলের পানি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং লবণাক্ততা থাকে না। ফলে প্রবল স্রোত এবং জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। পাশাপাশি ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। বর্ষায় নদীর স্রোত ও জোয়ার-ভাটার কারণে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু অনাবৃষ্টি, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ডুবোচর, বালি উত্তোলন, দূষণ ও অবকাঠামো নির্মাণে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রে পানির স্তর ও লবণাক্ততা বাড়া, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, নার্সারি এলাকার পরিবর্তনও হুমকি সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত 'হিলসা ফিশারিজ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন সময়ে ইলিশ নিয়ে হওয়া গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ইলিশ সাধারণত সারা বছরই ডিম ছাড়ে। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এ দুই মাস ভরা মৌসুম।
পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে পরিপক্ব ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য মেঘনার মোহনায় চলে আসে। এই সময়ে প্রচুর সংখ্যক মা ইলিশ ধরা পড়ে, যার ৯০-১০০ শতাংশই ডিম ধারণ করে থাকে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন, 'ইলিশ গভীর পানির মাছ। ডুবোচরে বাধা পেলে সমুদ্রে ফিরে যায়। বালি উত্তোলন, দূষণ, শিল্পকারখানার বর্জ্যও বড় সমস্যা।'
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, 'নদীর চেয়ে সমুদ্রে ইলিশ ধরতে খরচ বেশি হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'ডিম ছাড়া, বেড়ে ওঠা ও সমুদ্রে গিয়ে প্রজননের প্রস্তুতি—এই তিন স্তরে ইলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।'
বরিশালের মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আলফাজউদ্দিন শেখ বলেন, 'স্টক অ্যাসেসমেন্ট করা জরুরি। পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাসহ চলমান কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।'
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগীতা করেছেন আমাদের বরিশাল প্রতিনিধি সৈয়দ মেহেদি হাসান।)