জাকসু নির্বাচন সামনে রেখে যা ভাবছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা

মুক্তধারার সংস্কৃতি চর্চার চরণক্ষেত্র হিসেবে সমাদর রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি)। এই বৈশিষ্ট্যেই দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জাবিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করেও দেয়। এখান থেকে উঠে এসেছিলেন হুমায়ুন ফরীদির মতো অসামান্য সব অভিনেতা, যাদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা অবদান রাখে জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে।
সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলেন, প্রকৃতির সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাস শুধু পড়াশোনার স্থান নয়, বরং বিনোদন ও সৃজনশীলতারও এক ভিন্ন লীলাভূমি। এখানকার সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বরাবরই বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা রকম সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রেখেছে। আশির দশক থেকে ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, ধ্বনি, জলসির মতো সংগঠনগুলো, যারা নাটক, কবিতা পাঠ, সংগীতানুষ্ঠান, বিতর্ক, সেমিনার থেকে শুরু করে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ধারাকে বজায় রেখেছে। ১৯৮০ সালে সেলিম আল দীন রচিত 'শকুন্তলা' নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে মুক্তমঞ্চের যাত্রা শুরু হয়, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
এদিকে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে সংগঠিত ও পরিচালনার জন্য রয়েছে সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক এবং সহ-সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক পদ। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও ছাত্রশিবিরের প্যানেলে ইতোমধ্যে এ দুই পদের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও—-ছাত্রদল ও অন্যান্য বাম সংগঠনগুলো এখনও তাদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করতে পারেনি। এমতাবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জাকসু নির্বাচনে তাদের প্রত্যাশা প্রকাশ করেছে।
টিএসসির অবকাঠামোগত উন্নয়ন চায় সাংস্কৃতিক জোট
টিএসসি কেন্দ্রের অবকাঠামোগত সমস্যা দীর্ঘদিনের। ছোট ছোট কক্ষে একসাথে অনেকগুলো সংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তবে প্রত্যাশার জায়গা থেকে সাংস্কৃতিক জোটের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলাম মেঘ বলেন, "ক্যাম্পাসে যেন একটি সহমর্মিতার জায়গা থাকে। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী ও ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা সমান সম্মান পায়। জাহাঙ্গীরনগরে যেমন বাউল গান হবে, তেমনি কাওয়ালী ও গজলও থাকবে। আমরা চাই একটি ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) পরিবেশ, যেখানে কেউ হীনমন্যতায় ভুগবে না, নিজেকে আলাদা মনে করবে না। সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনো সংগঠনই যেন আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। সবাই যেন স্বাধীনভাবে সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে।"
ক্যাম্পাসে সহমর্মিতার পরিবেশ চায় আবৃত্তি সংগঠন 'ধ্বনি'
ধ্বনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম একটি আবৃত্তি সংগঠন। ১৯৯৬ সাল থেকে পথচলা এই সংগঠনটি বরাবরই গণমুখী শিক্ষা চেতনায় বিশ্বাস, আবৃতি, বাক উৎকর্ষতা ও শুদ্ধ উচ্চারণ চর্চার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত।
জাকসুতে সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা নিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল বলেন, "ক্যাম্পাসে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সমান মর্যাদা পাবে। বাউল গান, কাওয়ালী, গজল সব ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন সমানভাবে গুরুত্ব পাবে। আমরা চাই, কেউ হীনমন্যতায় ভুগবে না, কেউ নিজেকে আলাদা মনে করবে না। এখানে সবাই স্বাধীনভাবে সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে।"
ক্যাম্পাসে মুক্তচিন্তা ও শিল্পচর্চার অনুকূল পরিবেশ চায় বাগছাস
আসন্ন জাকসুতে প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) মনে করে, সংস্কৃতি রক্ষা মানে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখা।
রাজনৈতিক সংগঠনটির পক্ষ থেকে ভিপি পদপ্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, "মুক্তচিন্তা, সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও শিল্পচর্চার জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কর্পোরেট আগ্রাসন ও অসংস্কৃতিক ধারা প্রতিরোধ করে ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চর্চা এগিয়ে আনা হবে। সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি অন্যায় ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের শক্তিশালী হাতিয়ার।"
টিএসসির সংস্কার ও সৃজনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায় বাম সংগঠনগুলো
দীর্ঘদিন ধরেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নির্দলীয় আন্দোলনকর্মী ও বাম রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে একত্রে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। বাম সংগঠনগুলো "সম্প্রীতির ঐক্য" নামক একটি জাকসু প্যানেল গঠন করেছে, যা শিগগিরই ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এনিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের পক্ষ থেকে সভাপতি অদ্রি অংকুর বলেন, "টিএসসির রুম, ওয়াশরুমসহ কাঠামোগত সমস্যার সমাধান, শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ও সৃজনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা, এছাড়াও মুক্তমঞ্চের সংস্কার এবং টিএসসির সংগঠনগুলোকে আরও অনুদান প্রদানের বিষয়টিও জাকসুর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চাই।"
মুক্তমঞ্চকে সৃজনশীল শিল্পচর্চার জায়গা হিসেবে দেখতে চায় ছাত্রশিবির
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই সর্বপ্রথম মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠা হয়। অনেকেই মুক্তমঞ্চকে শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মনে করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সারাদেশে অনন্য বলে মনে করে ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা আশা রাখে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে সাহিত্য উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব ও বইমেলা আয়োজন করা হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসের দেয়ালচিত্র ও মুক্তমঞ্চকে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল শিল্পচর্চার জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
আদিবাসী সংস্কৃতিকে স্থান দিতে চায় অনেকেই
এবারের জাকসু নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকেও প্রার্থিতা করছেন অনেকে। তাদের পক্ষ থেকে অনেকেই জাবিতে আদিবাসী সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে কাজ করতে চান। তারা সবাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চান। স্বতন্ত্র পদপ্রার্থী হিসেবে এমনই বলছেন ইফরাত আমিন অক্ষর।
তিনি বলেন, "যাদের কাঁধে ভর করে আমরা সাংস্কৃতিক রাজধানীর খ্যাতি অর্জন করেছি, তাদেরকে আরও সহায়তা দিতে চাই। টিএসসির অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলোর কাঠামোগত সমস্যা, বিশেষ করে রুম সংকট সমাধানসহ সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এসব বাধা দূর করা আমাদের লক্ষ্য। ক্যাম্পাসে অবস্থানরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেন উপযুক্তভাবে উপস্থাপিত হয়। হিন্দুদের কালিপূজা, আদিবাসীদের বিজু উৎসব, কাওয়ালী, কীর্তন সবকিছু যেন সমানভাবে গুরুত্ব পায়। ইনক্লুসিভ জাহাঙ্গীরনগর হিসেবে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মিলেমিশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতে পারবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।"
মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির প্রয়াশ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য কিংবা এর সংস্কৃতিমনা পরিবেশে স্বাধীনচেতা মানুষ যেমন রয়েছে, তেমনি আছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা, যারা থিয়েটার-নাটকের মাধ্যমে কখনো মানুষের প্রত্যয়কে উজ্জীবিত করেছেন, কখনোবা নাটক, গান কিংবা থিয়েটার হয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। ঠিক সেই লক্ষ্যেই আসন্ন জাকসু নির্বাচনে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির প্রয়াশ ব্যক্ত করেছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী।
রাঈদ, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে "অদম্য ২৪"-এর নকশাকার এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে রূপ দিয়েছেন তাঁর নকশায়, বলেন, "শিল্প ও সংস্কৃতি শুধু নান্দনিকতার প্রতীক নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের গভীরে প্রোথিত আন্দোলন। বিভেদ ও সংকীর্ণতার কারণে জাহাঙ্গীরনগরের ঐতিহ্য ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাই ক্যাম্পাসে সংস্কৃতিচর্চা হোক মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।"