সৈয়দপুরে তৈরি হচ্ছে রেলওয়ে যন্ত্রাংশ, হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ

উত্তরবঙ্গের হালকা প্রকৌশল শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি নীলফামারির সৈয়দপুর। এখানকার শিল্প ও বাণিজ্যে বড় অবদান রাখছে এই শহর। বর্তমানে ৫০০ এর বেশি কারখানায় বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়। এরমধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে রেলওয়ের যন্ত্রাংশ—যার বার্ষিক বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সময় আমদানিনির্ভর ছিল এ শিল্প। এখন সেটিই সৈয়দপুরের হালকা প্রকৌশল খাতকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে অনেকের জন্য। রেলওয়ের যন্ত্রাংশ তৈরি করে কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন বড় উদ্যোক্তা।
তাদের মধ্যে একজন মো. নাইম খান। তিনি নাইম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক। নীলফামারির সৈয়দপুরে জন্ম হলেও চাকরিসূত্রে একসময় ছিলেন চট্টগ্রামে। সেখানে এক রেলওয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে থেকে শিখে নেন যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ। পরে ৯০–এর দশকে সৈয়দপুরে ফিরে যুক্ত হন হালকা প্রকৌশল শিল্পে। নিজ কারখানায় রেলওয়ের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি করে সরবরাহ শুরু করেন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়।
ক্রমেই রেলওয়ের যন্ত্রাংশের চাহিদা বাড়তে থাকায় কারখানাও বড় হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে শুরু করা কারখানায় এখন কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ জন মানুষের।
নাইম খান বলেন, "রেলওয়ের ইঞ্জিন বাদে প্রায় সব ধরনের পার্টস আমার কাছে পাওয়া যায়। আমি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার নিয়মিত ঠিকাদার। এছাড়া, দিনাজপুর কয়লাখনিতেও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করি।"
বছরে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় গড়ে ৩০ লাখ টাকার পার্টস সরবরাহ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, "সৈয়দপুরে প্রায় শতাধিক কারখানায় রেলওয়ের যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। কারও তৈরি পণ্য সরাসরি রেলওয়েতে যায়, আবার কেউ ঠিকাদারের মাধ্যমে সরবরাহ করেন। দিন দিন চাহিদা বাড়ছে এ শিল্পের।"
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৮৭০ সালে ব্রিটিশরা সৈয়দপুরে গড়ে তোলে বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের বহু শ্রমিক এখানে কাজ নেন। অবসরে গিয়ে অনেকেই এ শহরেই গড়ে তোলেন হালকা প্রকৌশল শিল্প, যেখানে শুরু হয় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উৎপাদন।

নাইম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক নাইম খানের বাবা নিজাম উদ্দিনও ছিলেন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার কর্মী। বাবার অনুপ্রেরণাতেই তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন।
সৈয়দপুরের হালকা প্রকৌশল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অন্তত ১০ জন উদ্যোক্তা জানান, পাকিস্তান আমলে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তখন অন্যান্য পার্টস উৎপাদন বেশি ছিল। স্বাধীনতার পর সৈয়দপুরে এক ধরনের শিল্পবিপ্লব ঘটে। এখন এমন কিছু নেই, যা এখানে তৈরি হয় না এখানে। অনেকে রসিকতা করে সৈয়দপুরকে দেশের 'দ্বিতীয় জিঞ্জিরা' নামেও অভিহিত করেন।
ব্যবসায়ী ও বিসিক সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে সৈয়দপুরের কারখানাগুলোতে বাইসাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশসহ রেলওয়ের নানা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে কানেক্টিং, হাউজিং, হোস পাইপ, ইঞ্জিনের ঢাকনা, কাপলিং, বেয়ারিং কভার, ক্যাপ ইঞ্জিন, রেলকোচের দরজা–জানালা ও হাতল। উদীয়মান এই শিল্পে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রেলওয়ের যন্ত্রাংশে।
প্রায় ১০ বছর ধরে সৈয়দপুর রেলওয়েতে সরাসরি যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে 'কোর ইঞ্জিনিয়ারিং' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আল আমীন বলেন, "রেলওয়ে ও অন্যান্য সুবিধার কারণে রংপুর বিভাগের সৈয়দপুরে হালকা প্রকৌশল শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়েছে। এখানে দক্ষ কারিগর থাকায় দেশীয় প্রযুক্তির প্রায় সব যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব। রেলওয়ে কারখানা থাকার কারণে প্রায়ই যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়, সেই চাহিদা থেকেই শহরজুড়ে অসংখ্য কারখানা গড়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, রেলওয়ের যন্ত্রপাতি তৈরির কাঁচামাল অনেক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আবার যশোর ও বগুড়ার মতো জায়গা থেকেও চাহিদামতো যন্ত্রাংশের নকশা সংগ্রহ করা হয়। পরে সৈয়দপুরের কারিগররা সেগুলো ব্যবহারোপযোগী করে তোলেন। দক্ষতার কারণেই এখানে কোটি কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে।
১৯৯৫ সাল থেকে সৈয়দপুর বিসিক শিল্প এলাকার সামনে 'মাকসুদ আলম ট্রেডার্সে' কাজ করছেন রবিউল ইসলাম। ঢাকা থেকে কাজ শিখে এসে তিনি প্রথমে ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন।
রবিউল বলেন, "বর্তমানে চোখ দিয়েই হুবহু কপি করে যন্ত্রাংশ বানাতে পারি। নাট, বল্টু, ওয়াশার, বুশসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের অর্ডার আসে। মহাজনের মাধ্যমে এসব সরবরাহ করি।"
কারখানা মালিকরা জানান, এসব যন্ত্রাংশ তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় পুরোনো লোহা, ইস্পাত শিট, জাহাজ ভাঙা লোহা, অ্যাঙ্গেল, রড ইত্যাদি। এগুলো মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে সংকট হলে বিদেশ থেকেও আমদানি করা হয়।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সৈয়দপুর জেলা শাখার সভাপতি ও মেসার্স আব্দুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের পরিচালক এরশাদ হোসেন পাপ্পু বলেন, "এখানে প্রায় ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান হালকা প্রকৌশল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রেলওয়ের যন্ত্রাংশ তৈরি করে বিসিকের অনুমোদন নিয়ে সরবরাহ করছে।"
"বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়, কাজ করেন কয়েক হাজার মানুষ। প্রণোদনা, সহজ ঋণ সুবিধা ও আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে এ শিল্প আরও বিকশিত হবে," যোগ করেন তিনি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা ও পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে বিসিক নীলফামারি অফিস থেকে উপ–ঠিকাদারি নিবন্ধন নিতে হয়।
বিসিক নীলফামারি শিল্পনগরী কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, "সৈয়দপুর রেলওয়েতে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ৫০টি প্রতিষ্ঠান তাদের দপ্তরে নিবন্ধিত। এ প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে সরাসরি রেলওয়ের কাছে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে পারে। এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। এটি এখন ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি শিল্প।"