রাজউকের নির্দেশ অমান্য করে অনুমোদিত এলাকার বাইরে জমির প্রচারণা চালাচ্ছে আশিয়ান সিটি

আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে কেবল ৩৩ একর জমির অনুমোদন দেওয়া হলেও, এক হাজার একরেরও বেশি জমি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের আশিয়ান সিটি প্রকল্পের প্রচারণা করছে বলে জানিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
গত বছরের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৩ একরের মধ্যে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয়। আদালতের রায়ের পর রাজউক অনুমোদনবিহীন এলাকায় পরিচালিত সব ধরনের বিজ্ঞাপন, বিক্রয় ও প্রচার বন্ধের নির্দেশ দেয়।
একই সঙ্গে প্রকল্পের সীমানা যাচাই ও অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়।
১৭ আগস্ট রাজউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আদালতের রায়ে আশিয়ান সিটি কেবল ৩৩ একরের মধ্যে কার্যক্রম চালাতে পারবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শনে দেখা গেছে তারা ৬০ থেকে ৭০ একর জমি ব্যবহার করছে।'
তিনি বলেন, ' তাদেরকে ৩৩ একরের সীমানা চিহ্নিত করে এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। আমরা কাগজপত্র পর্যালোচনা করছি, তবে শেষ পর্যন্ত তারা ৩৩ একরের অনুমোদনও পাবে কিনা সন্দেহ।'
এর আগে গত ৪ আগস্ট রাজউক জানায়, ঢাকার দক্ষিণখানে অবস্থিত আশিয়ান সিটি প্রকল্প এখনো তাদের অনুমোদন পায়নি। তবুও বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, অনলাইন ও বিভিন্ন মাধ্যমে জমি বিক্রির প্রচারণা চলছে, যা অবৈধ।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়, বেসরকারি আবাসিক ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ (সংশোধিত ২০১১ ও ২০১৫) এবং রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া জমি বিক্রি বা বিজ্ঞাপন প্রচার করলে ন্যূনতম ১০ লাখ টাকা জরিমানা, সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
নোটিশে আরও বলা হয়, এসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ না করলে এবং নির্ধারিত সময়ে নথিপত্র জমা না দিলে বিজ্ঞাপন বন্ধ, জরিমানা আদায়সহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজউক জানায়, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এবং ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ (সংশোধিত) অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করলে তবেই প্রকল্প অনুমোদন পাবে। অনুমোদনের আগে কোনো বিক্রয়, প্রচার বা উন্নয়ন চলতে পারবে না।
আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের মিডিয়া প্রধান শফিকুল ইসলাম শাওন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা কোর্ট অনুমোদিত ৩৩ একরের মধ্যেই কাজ করছি। রাজউকের নির্দেশ মেনে অনুমোদনবিহীন এলাকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করেছি।'
তিনি বলেন, 'তবে আমাদের প্রকল্পের মোট এলাকা প্রায় এক হাজার একর। ধীরে ধীরে জমি কিনে প্রকল্পে যুক্ত করছি। রাজউকের পাঠানো নোটিশেরও জবাব দিয়েছি।'
তবে মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজউক এখনও আশিয়ানের কাছ থেকে নোটিশের কোনো জবাব পায়নি।
রাজউকের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই আশিয়ান সিটি প্রকল্প চলছে। গত ১৪ আগস্ট তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় এখনো বিলবোর্ড, ব্যানার ও সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।
ফেসবুক পোস্টের পক্ষে যুক্তি দিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, 'নিজস্ব ফেসবুকে এ্তটুকু তো আমরা করতেই পারি—এগুলো আমরা বুস্ট করছি না। বিলবোর্ডগুলো শুধু আমাদের কেনা জমিতেই রয়েছে—যেখানে লেখা আছে, এই জমির মালিক আশিয়ান সিটি। ধীরে ধীরে এগুলো মূল প্রকল্পে যুক্ত হবে।'
২০০৬ সালে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বারুয়া ও ডুমনি মৌজায় আশিয়ান সিটি প্রকল্পের প্লট বিক্রি শুরু করে আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড।
২০০৫ সালে রাজউক ও ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে ৪৩ একর জমি উন্নয়নের অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৯৭ একর করা হয়—যা মূল অনুমোদনের প্রায় ৩০ গুণ।
২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ আটটি পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানায়।
হাইকোর্ট প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। পরে হাইকোর্টের বড় বেঞ্চ মামলাটি পর্যালোচনা করে ২০১৬ সালের আগস্টে আগের রায় বাতিল করে।
২০১৭ সালের ৭ আগস্ট আপিল বিভাগ বড় বেঞ্চের রায় স্থগিত করেন। এরপর ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ মঞ্জুর করে হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন।
পরে ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় বহাল রাখেন, যাতে উত্তরা ও বিমানবন্দরসংলগ্ন ৩৩ একরে প্রকল্প চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
সূত্র ও গণমাধ্যমের তথ্যমতে, আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া দীর্ঘদিন ধরে আইন ও রাজউকের বিধি অমান্য করে আবাসন ব্যবসা চালাচ্ছেন।
তার বিরুদ্ধে খিলক্ষেত, উত্তরা ও ভাটারা থানায় জুলাই আন্দোলনের অন্তত ১২টি হত্যা মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জামিন জালিয়াতির অভিযোগও আছে এবং বর্তমানে তিনি পলাতক।