জাইকা অর্থায়িত ৩ প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে পুনঃআলোচনায় যাবে সরকার: পরিকল্পনা উপদেষ্টা

জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপরেশন এজেন্সি) অর্থায়নে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন উপাদানে সরকার অতিরিক্ত ব্যয় কমানোর চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন উপাদানে ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি, যার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রোববার (১৭ আগস্ট) শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "মেট্রোরেলের চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে জাপানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে আগের সরকারের সময়ে। যেহেতু চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে, তাই আমরা কিছুটা দুর্বল অবস্থানে আছি। জাইকার সঙ্গে চুক্তি বন্ধ করার সুযোগ নেই।"
বৈঠকে ৯,৩৬২ কোটি টাকার ১১টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জে সরকারি ১০০ একর জমিতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প, তবে তা পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত কিছু শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন করা হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, "জাপানি ঠিকাদারদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই চুক্তি হয়েছে। এখন প্রকল্পগুলো বিলম্বিত হলেও ঋণের সুদ বাড়বে। অন্যদিকে, জাইকা একবার চুক্তি হলে ব্যয় কমাতে রাজি হয় না। এ কারণে সরকার চেষ্টা করছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে—বাংলাদেশে কত বেশি খরচ হচ্ছে, সেটি দেখিয়ে দর-দেনা করা যায় কি না।"
"যেহেতু চুক্তি হয়ে গেছে, ফলে আমাদের করার মতো তেমন কিছু নেই। তবুও আমরা চেষ্টা করছি, যতদূর সম্ভব ব্যয় সাশ্রয় করার চেষ্টা করব," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, "বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প অনুমোদন, দরপত্র আহ্বান ও চুক্তির সবকিছুই আগের সরকারের সময় হয়েছে। বর্তমানে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী সংস্থা ডিএমটিসিএলে একজন নতুন পরিচালক যোগ দিয়েছেন। তিনি প্রকল্পের প্রতিটি অংশ পর্যালোচনা করে দেখেছেন, আমাদের দেশে মেট্রোরেল নির্মাণে অন্য দেশের তুলনায় কত বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে।"
জাপানের অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫৩,৯৭৭ কোটি টাকার এমআরটি লাইন-১ প্রকল্প। এর আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯.৮৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল মেট্রোরেল লাইন এবং ১২টি পাতাল স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৬৯ কিলোমিটার উড়াল মেট্রোরেল লাইন, যেখানে ৭টি উড়াল ও ২টি পাতাল স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এমআরটি লাইন-১ এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩১.২৪২ কিলোমিটার। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
জাইকার অর্থায়নে চলমান আরেকটি প্রকল্প হলো এমআরটি লাইন-৫ (নর্দার্ন রুট), যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১,২৩৮ কোটি টাকা।
এমআরটি লাইন-৬ এর মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।
শর্তসাপেক্ষে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন
এদিকে, একনেক সভায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়ার ১০০ একর অকৃষি খাস জমিতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প উপস্থাপন করা হলে শর্তসাপেক্ষে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, একনেক ৫১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন দিলেও এর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হবে। সভায় উপস্থিত সূত্রে জানা গেছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এই অনুমোদন নিতে হবে।
শাহজাদপুরের যে স্থানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটি চলনবিলের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এ কারণে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশবিদ এবং পানি বিশেষজ্ঞরা এ স্থানে ক্যাম্পাস নির্মাণে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি, এখানে শতাধিক খাল, বিল, বড়াল নদীসহ অর্ধশতাধিক নদীর পানি মিলিত হয়। এই পানিপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত যমুনা নদীতে গিয়ে মেশে। ফলে ক্যাম্পাস নির্মাণ হলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এর আগে, গত মে মাসে প্রকল্পটি একনেকে উত্থাপিত হলেও পর্যালোচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরও বলেন, "২০১৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত শাহজাদপুরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রয়োজন।"
তিনি জানান, বর্তমানে যে এলাকায় ক্যাম্পাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি আগে চারণভূমি ছিল। ২০১৮ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় এটি অকৃষি জমি হিসেবে ঘোষণা করে ভূমি অধিগ্রহণে অনাপত্তি দেয়। তখনই বলা হয়েছিল, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এখন সেই শর্ত পূরণের শর্তে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জুলাইয়ে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি
জুলাই মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ১ শতাংশেরও কম।
পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবারের জুলাই মাসে বাস্তবায়ন হার কমেছে, যা ভালো লক্ষণ নয়। তিনি বলেন, "২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ ছিল আন্দোলন, তখন সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এবার তো এডিপি বাস্তবায়নে গতি আসার কথা।"
তিনি আরও বলেন, "এখনও শোনা যাচ্ছে অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি। আবার অনেক প্রকল্প পরিচালক স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে গেছেন। এবারের এডিপি বাস্তবায়ন স্বাভাবিক গতিতে হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এর আকারও বাস্তবসম্মত হয়েছে। তাই আমরা আশা করছি, পূর্ণ এডিপি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এজন্য আমরা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তাগাদা দেব, যেন তারা বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ করতে পারে। এই অর্থবছরে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, "ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কারণে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এডিপি সংশোধন করা হবে। তবে এর জন্য পুরো বাজেটের রূপরেখা আগেই দেওয়া উচিত।"
মোট ১১টি প্রকল্প অনুমোদন
একনেক সভায় মোট ৯,৩৬২ কোটি টাকার ১১টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—বিভিন্ন উপজেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত), আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন, বাপবিবো'র বিদ্যমান শিল্পসমৃদ্ধ এলাকার ৩৩/১১ কেভি আউটডোর উপকেন্দ্রের আধুনিকায়ন ও ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিএমআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড (দ্বিতীয় সংশোধিত)।