চানখাঁরপুলে পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছি: ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার কিছু আগে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার এক সাক্ষী দাবি করেছেন, পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ বুধবার (১৩ আগস্ট) নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা শহীদ আহম্মেদ এ দাবি করেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সেদিন দুটি ঘটনায় মোট তিনজন সাক্ষ্য দেন।
এর মধ্যে ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে মো. ইয়াকুব (৩৫) নিহত হওয়ার ঘটনায় সাক্ষ্য দেন তার মা রহিমা আক্তার ও প্রতিবেশী শহীদ আহম্মেদ। ওইদিন নিহত আরেকজন, ইসমামুল হক (১৭)-এর ভাই মো. মহিবুল হকও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।
ইয়াকুব ছিলেন নিউমার্কেট এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি ম্যান। তিনি নাজিমুদ্দিন রোডের শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের পাশে মিলি গলির বাসিন্দা। ইসমামুল চকবাজারের গফুর সওদাগরের দোকানে কাজ করতেন।
সেদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন বি এম সুলতান মাহমুদ, মিজানুল ইসলামসহ কয়েকজন প্রসিকিউটর।
রহিমা আক্তারের সাক্ষ্য
ইয়াকুব নিহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রহিমা আক্তার বলেন, 'আমার ছেলে ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল নাজিমুদ্দিন রোডে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি লাগার কথা শুনে চিৎকার করে বাসা থেকে বের হয়ে গলিতে যাই। মহল্লার লোকজন আমাকে যেতে দেয়নি। তারা বলেছিল, আমার ছেলে সুস্থ আছে, তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন আমার ছেলের বয়স ছিল ৩৫ বছর। কিন্তু প্রতিবেশীরা কান্না শুরু করলে আমার সন্দেহ হয়, কিছু একটা হয়েছে।'
রহিমা বলেন, 'বেলা আনুমানিক ২টার দিকে দেখি, আমার ছেলের লাশ খাটিয়ায় করে গলির ভেতর আনা হচ্ছে। শহীদসহ অনেকেই ছিল। শরীর থেকে তখনও খাটিয়া বেয়ে রক্ত পড়ছিল। কাপড় সরিয়ে দেখি, পেটে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে, রক্ত থামছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'পরে টিভি নিউজ, ভিডিও ও অন্যান্য মাধ্যমে দেখি, যারা গুলি করেছে তারা ছাপা কাপড়ের পোশাক পরা ছিল। পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে পড়ে যায়। প্রতিবেশী শহীদ এই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেন।'
তিনি ছেলের হত্যার সঙ্গে জড়িত ও নির্দেশদাতা সবার বিচার দাবি করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নাম উল্লেখ করেন নির্দেশদাতা হিসেবে।
শহীদ আহম্মেদের সাক্ষ্য
এরপর সাক্ষ্য দিতে গিয়ে শহীদ আহম্মেদ (৪০) বলেন, 'আমি, আমার ভাতিজা ইয়াকুব, ছেলে সালমান, এলাকার রাসেল, সুমন, সোহেলসহ আরও অনেকে সকাল ১১টা থেকে ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিই। আনুমানিক ১১টা ৩০ মিনিটে চানখাঁরপুলে পৌঁছে দেখি হাজার হাজার লোক চারদিক থেকে জড়ো হচ্ছে। তখন দেখি চানখাঁরপুল মোড়ের উল্টোদিকে অনেক পুলিশ ও ছাপা পোশাকধারী পুলিশ রয়েছে। পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি।'
তিনি জানান, পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তারা ছত্রভঙ্গ হলে আবার সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
শহীদ বলেন, 'আমার পাশের একজনের পায়ে গুলি লাগে। তাকে সরাচ্ছিলাম, তখন কেউ একজন এসে বলে- আপনার ভাতিজা ইয়াকুবের গুলি লেগেছে। আমি আহত লোকটিকে অন্যের কাছে রেখে ভাতিজার কাছে যাই। আরও দু'জনসহ তাকে অটোরিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার জানান, ইয়াকুব মারা গেছে।'
তিনি পরে জানতে পারেন, 'শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএমপির মো. ইমরুল ও ইন্সপেক্টর আরশাদের উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, নাসিরুল, ইমাজ গুলি চালায়। আরও অনেকে ছিল।'
মহিবুল হকের সাক্ষ্য
তৃতীয় সাক্ষী, চট্টগ্রামের মো. মহিবুল হক (২১) বলেন, 'আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম। আমার ভাই ইসমামুল হক ঢাকা চানখাঁরপুলে শহীদ হয়েছে। দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে ভাইয়ের মোবাইল থেকে এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি আছে।'
তিনি বলেন, 'যান চলাচল বন্ধ থাকায় সেদিন ঢাকায় যেতে পারিনি। পরের দিন সকালে আমি, আম্মা ও দুই আত্মীয় ঢাকায় এসে জানতে পারি, ভাইকে মিটফোর্ড থেকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে গফুর সওদাগরকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সামান্য কথা হয়। সে সিসিইউতে ছিল। অবস্থা খারাপ হলে রাত ১০টার দিকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ৭ তারিখ সকালে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পর বিকেল ৪টার দিকে সে মারা যায়।'
মহিবুল আরও বলেন, 'চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত করেননি। আমরা ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে লাশ চট্টগ্রামে নিয়ে আসি। সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে রাত ২টায় বাড়ি পৌঁছাই।
পরদিন জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে ইসমামুলকে দাফন করা হয়।'
তিনি ট্রাইব্যুনালে জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, এডিসি আক্তারুল ইসলাম, ইমরুল ও আরশাদের নির্দেশে সুজন হোসেন, নাসিরুল ইসলাম, ইমাজ হাসান ইমনসহ আরও অনেকে গুলি চালিয়েছে।
ভাইয়ের হত্যাকারী ও নির্দেশদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মহিবুল।