‘নির্যাতনকারীর’ স্কেচে মেজর আফিজের ‘মিল’ পেয়েছেন কার্টুনিস্ট কিশোর, চান গ্রেপ্তার

কারাগার থেকে বেরিয়ে তাকে 'নির্যাতন' করা ব্যক্তিদের যেসব স্কেচ এঁকেছিলেন সেগুলোর একটিতে সাবেক ডিজিএফএআই কর্মকর্তা মেজর আফিজুর রহমানের 'মিল' খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর। জানিয়েছেন গ্রেপ্তারের দাবিও।
সোমবার (১১ আগস্ট) 'মেজর আফিজ আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি' শিরোনামে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী কার্টুনিস্ট কিশোর নিজের আঁকা স্কেচের ছবি, অবসরপ্রাপ্ত আফিজের একটি ছবি এবং ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আফিজের ছবি সংযুক্ত করে সাংবাদিক সাইদুর রহমানের ফেইসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করেন।
গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে কার্টুনিস্ট কিশোর লেখেন, 'সার্ভিসে ধান্ধাবাজ, অসৎ বলে পরিচিত এই আফিজকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বহু গুম ও নির্যাতনের পেছনের ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি।'
পোস্টে কিশোর লেখেন, 'আফিজ ২০২০ সালে ডিজিএফআইয়ের মিডিয়া উইংয়ে কর্নেল শাম্মী ফিরোজের অধীনে কাজ করতেন এবং দীর্ঘদিন মুশতাক ভাইয়ের ওপর নজর রাখতেন। তিনি আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাতের খুব কাছের ছিলেন, যিনি স্বৈরাচার হাসিনার 'ক্যাশিয়ার' হিসেবে পরিচিত।'
আফিজের বাবা বিগত বিএনপি সরকারের এক মন্ত্রীর এপিএস ছিলেন বলেও ওই পোস্টে দাবি করেন কিশোর।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৫ মে কার্টুনিস্ট কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমেদকে 'সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর' অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব-৩-এর ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক ১১ জনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় এ মামলা দায়ের করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা 'আই অ্যাম বাংলাদেশি' নামে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়েছেন- যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়।
এ মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়। পরে ওই বছরের ৪ মার্চ প্রায় ১০ মাস পর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান কিশোর।
এরপর 'অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন' চালানোর অভিযোগে মামলা করেন কিশোর। 'হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ' আইনে নাম-পরিচয় না জানা ব্যক্তিদের আসামি করেন তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, '২০২০ সালের ৫ মে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে, তার বক্তব্য অনুযায়ী, ২ মে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় তার বাসা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যান ১৬-১৭ জন সাদাপোশাকধারী ব্যক্তি। তারা কিশোরকে হাতকড়া ও মুখোশ পরিয়ে একটি অচেনা, নির্জন স্থানে নিয়ে যান এবং স্যাঁতসেঁতে একটি কক্ষে ৪ মে পর্যন্ত তার ওপর নির্যাতন চালায়।
এই সময়ে তারা তার আঁকা বিভিন্ন কার্টুন দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক পর্যায়ে তার কানে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় মারেন একজন, যার ফলে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে যান এবং কিছু সময় বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েন। কান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এর পরও তারা আবারও তাকে মারতে শুরু করেন।
৫ মে তিনি নিজেকে র্যাব কার্যালয়ে দেখতে পান এবং সেখানে লেখক মুশতাক আহমেদকেও দেখতে পান।'
কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি সেই সময়ের 'অত্যাচারকারীদের' স্কেচ আঁকেন। সম্প্রতি জনকণ্ঠ ভবন 'দখল' ইস্যুতে তার ফেসবুকের এক বন্ধু ব্লগার, লেখক ও সাংবাদিক আরিফ জেবতিকের একটি পোস্টে মেজর আফিজের নাম ও ছবি প্রকাশ্যে আসায় বিষয়টি আবার তার নজরে আসে।
সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, 'কারাগারে থেকে ভাবতাম, আমি ফরেনসিক আর্ট যেহেতু করতাম, তাদের ছবি আঁকব। আমি বের হওয়ার পরই আঁকছি। তিনজনের কথা আমার মনে আছে বিশেষ করে। তার মধ্যে দুজনেরটা আঁকছি। আরেকজনের চেহারা নিয়ে অনেকগুলো স্কেচ আঁকছি, শেষমেশ আউটপুট দিতে পারি নাই।'
আফিজের 'স্কেচটা শতভাগ নিশ্চিত' হওয়ার কথা তুলে ধরে কিশোর বিডিনিউজকে আরও বলেন, 'যে গ্রুপটা শান্তিনগরে আমার বাসায় ধরতে আসছিল, ওই গ্রুপের একদম সে সামনে ছিল। অ্যাজ ইট ইজ হি ওয়াজ দ্য লিডার। সে নিজের পরিচয় দিয়েছিল যে, তার নাম জসীম।
"কাউকে ধরতে এলে বলে না, ধরতে আসছেন কোনো, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কিনা'। আমি এরকম জিজ্ঞেস করছিলাম। তখন আমারে বলছিল যে, 'এত কথা বলার দরকার নাই আপনি প্যান্ট পরেন'। আমি লুঙ্গি পড়া ছিলাম। বলে, 'প্যান্ট পরেন আর একটা ভালো শার্ট পরেন।"
"প্রচুর সিগারেট খাচ্ছিল, আর ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছিল। আমি বলতেছিলাম, 'কোনো শ্যুটিংটুটিং আছে না কি যে ভালো জামাকাপড় পরতে হবে।"
গ্রেপ্তার অভিযানের সময় স্কেচের এই চেহারা 'একেবারে সামনাসামনি ছিল' বলে মন্তব্য করে অজ্ঞাতস্থানে নির্যাতনের সময়ও এই চেহারা দেখার দাবি করেন তিনি।
সুইডেন প্রবাসী কিশোর আরও বলেন, 'চোখ বাধাবস্থায়তো মারধর করছে। তখন চোখের বাঁধন খুলে গিয়েছিল একবার-দুইবার। ওইটা খুলে গিয়েছিল, তখন আমি একবার দেখে ফালাইছি। যেহেতু আমি তাকে আগেও দেখছি, সেজন্য চিনে ফেলছি।'
'আরেকটা ছিল, একটু বেঁটে করে, যেটার মাথায় টাক ছিল। খুবই ফানি একটা টাক ছিল মাথার মাঝখানে। ওর কোকড়া চুল ছিল। ওইটাও আমার কাছে আছে। আঁকার পরে স্ক্যান করে রেখে দিয়েছি।'
কিশোর সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমার স্মৃতি থেকে আমি আসামির ছবি আঁকছি। এরকম প্রমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসেতো আর নাই।'
'আমার মেটাডাটা বলবে ওই ছবি কখন আঁকছি, আমার আইনজীবীর কাছে ছবি আছে। এমনকি আমার মামলার যে তদন্ত কর্মকর্তা ছিল পিবিআইয়ের, তার কাছে দিয়েছি। আমার একটা দাবি ছিল, আমাকে যেদিন উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেই দিন আশেপাশে প্রায় ১১টি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল, সেগুলোর ডকুমেন্ট ম্যানেজ করেন', যোগ করেন তিনি।
যা বলছেন আফিজ
তবে স্কেচের ব্যক্তিটি তিনি নন বলে দাবি করেছেন মেজর আফিজ।
কার্টুনিস্ট কিশোরেরঅভিযোগের বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আফিজ বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরকে বলেন, 'প্রথমত হচ্ছে আমি পাবলিক রিলেশন এবং মিডিয়া উইংয়ের অফিসার ছিলাম। যতদিন ডিজিএফআইতে আমি কাজ করেছি, আমি পাবলিক রিলেশন এবং মিডিয়া উইংয়ে কাজ করেছি।
'সুতরাং পাবলিক রিলেশন এবং মিডিয়া উইংয়ের কোনো একজন অফিসারের কাজের পারভিউ কতটুকু? তিনি কতটুকু কাজ করতে পারেন? ডিজিএফআইতো একটা অর্গানাইজড অর্গানাইজেশন।'

স্কেচে চশমা থাকলেও ওই সময়ে চশমা না পরার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'জিনিসটা আমাকে একজন পাঠিয়েছে, আমি দেখেছি। আমি চশমা পরা শুরু করেছি জাস্ট এই এক মাস।
'মানে এর আগে আমি কখনোই চশমা পরি নাই। একেবারে ছোটবেলায় ক্লাস ফোরে থাকতে পরতাম। এরপরে আর কখনোই আমি চশমা পরি নাই।'
কার্টুনিস্ট কিশোর 'কোথাও ভুল' করছেন সন্দেহ করে আফিজ বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরকে বলেন, নির্দিষ্ট কাজের বাইরে গিয়ে কখনও কোনো কিছু করেননি তিনি।
'ওনার সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি। হয়তো ওনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার ওনার সাথে কখনোই দেখা হয়নি।'
চশমার বাইরে স্কেচের সঙ্গে চেহারা অন্যান্য অংশের মিল থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'আসলে চশমা আমি পরতামই না কখনো। আপনি যদি ক্লোজ বা যে কারো কিছু জিজ্ঞাসা করেন, আমি কখনোই চশমা পরতাম না।'
আফিজ বলেন, 'একটা ক্লেইম করেছেন উনি। একটা চেহারা উনি লুক এলাইক মনে করছেন বা উনি বলছেন যে, ওনার কাছে মনে হয়েছে। কিন্তু আমি তো আমার জায়গা থেকে জানি যে, আমি এরকম কোনো কিছুতে ইনভলভ ছিলাম না।
'আমার কাজের গণ্ডিতেও ছিল না এবং ব্যক্তিগতভাবেও ছিলাম না এবং আমি নিজে জানি আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই কোনো অপরাধে জড়িত হইনি।'
নিজের ছবি এবং স্কেচের সঙ্গে মিল পান কি না, এমন প্রশ্নে তিনি একই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'আমি তো প্রথমেই ধরেন ছবিটাতে যেটা দেখেছি আমি চশমা দেখেছি। তো আমি যেহেতু কখনো চশমা পরিই নাই। সুতরাং এরপরে আর বাকিটা আমার কাছে মাথায় আসে নাই। কারণ একটি বিষয় হচ্ছে কখনো কোনোভাবেই এরকম কোনো কিছুতে আমি জড়িত ছিলাম না। মানে এটি তো একটি প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয় অবশ্যই।
'মানে অভিযোগটা কিন্তু খুব সিরিয়াস লেভেলের অভিযোগ। অনেক সিরিয়াস লেভেলের। এখন যেই জিনিসটি আমি কখনো করিনি। যেই জিনিসটাতে আমার জব রেসপন্সিবিলিটিও না।'
তবে তার বাবার বিএনপির কোনো মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার বিষয়টি নাকচ করেছেন আফিজ। তিনি জানান, তার বাবা তাইয়েবুর রহমান যুগ্ম সচিব অবস্থায় মারা গেছেন ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর। ৭৯ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে ছিলেন মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনে, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। কোনো মন্ত্রীর পিএস বা এপিএস ছিলেন না।
২০২০ সালে ডিজিএফআইয়ের গণমাধ্যমে উইংয়ে কর্নেল শাম্মী ফিরোজের থাকার তথ্য ফেইসবুক পোস্টে দিয়েছেন কিশোর।
তবে আফিজ বলেছেন, কর্নেল শাম্মী ডিজিএফআই ছেড়ে গেছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে সময়টাতে গণমাধ্যম উইংয়ের পরিচালক ছিলেন আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খান।
কিশোরের অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করে তিনি বিডিনিউজকে বলেন, 'একেবারে এটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হোক। তাহলে এটার সঠিক বিষয়টা বেরিয়ে আসবে। এটা তো সিরিয়াস লেভেলের অভিযোগ, সুতরাং সিরিয়াস লেভেলের অভিযোগ অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত।'
চশমা না পরার যে তথ্য আফিজ দিচ্ছেন, সে বিষয়ক এক প্রশ্নে কিশোর বলছেন, 'ডিসগাইজ দিতে পারে না! চশমা পরে কি, পরে না এইটা তো আমার জানার কথা না। সে তো ছদ্মবেশও ধারণ করতে পারে।
'আমি ১০০ ভাগ কনফার্ম সে। আমিতো কখনও এর ছবি দেখি নাই। অনেকে অনেক অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু কখনও এর নামতো বলতে পারে নাই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাকেতো কেউ ছবি দেখায় নাই। প্রথম আরিফ জেবতিকের পোস্টে ওর ছবি দেইখা তখন আমি দেখি আরেহ, এ-ইতো। তখন আমি নিজে চিন্তা করেছি, নিজে আবার মিলাইছি বসে আমার এই ছবি দিয়ে।
'এরপর আমি লোকজন থেকে খবর নিয়ে জানছি, সে ২০২০ সালে ডিজিএফআইতে ছিল, মিডিয়া উইংয়ে ছিল। ওর কাজই ছিল মিডিয়ার বিভিন্ন লোকজন সম্পর্কে তথ্য নিয়ে, হয়ত যে খবর পাইছিল মুশতাক ভাইয়ের সঙ্গে আল-জাজিরার কোনো একটা লিংকআপ আছে, অথবা সায়ের জুলকারনাইনের কোনো লিংক আছে, এটা লিংকআপ করতে করতে হয়ত সে মুশতাক ভাইকে টার্গেট করেছে। মুশতাক ভাইকে টার্গেট করার কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগের কারণে আমাকেও টার্গেট করেছে।'
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চিফ অপারেটিং অফিসার অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমানসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে 'ষড়যন্ত্র ও মব সৃষ্টি' করে অবৈধভাবে জনকণ্ঠ পত্রিকা দখলের অভিযোগ আনেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান।
তবে আফিজুর রহমান বিবিসি বাংলার কাছে জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।