‘আমরা এতিম হয়ে গেলাম, আমাদের নিঃস্ব করে দিল’

বাবাকে হারিয়ে বাড়ির সামনে নির্বাক মেয়ে নুপুর (১৮)। চোখ দুটি ছলছল করছে। বাবার কথা বলতেই আহাজারিতে যেন একাকার হয়ে এল পৃথিবী। বললেন, "আমরা এতিম হয়ে গেলাম। আমাদের নিঃস্ব করে দিল।"
কথাগুলো বলছিলেন, রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাসের মেয়ে। শনিবার রাতে তাকে চোর সন্দেহ মারধর করা হয়। সঙ্গে তার আত্মীয় মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ লালকে (৩৫) মারধর করেন স্থানীয়রা।
একপর্যায়ে রুপলাল ও প্রদীপ অচেতন হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। শনিবার রাতেই রূপলালকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আর গতকাল রোববার ভোরে মারা যান প্রদীপ।
স্বামীকে হারিয়ে রুপলাল দাসের স্ত্রী ভারতী দাসও শোকের মাতমে দিশেহারা। জানালেন, 'আমার নির্দোষ স্বামীকে কেন মারা হলো? কেন আমাদের সাথে এই অন্যায় হলো? আমরা এখন কার কাছে বিচার চাইব? আমরা এখন বাঁচব কীভাবে?'
আজ সোমবার রূপলাল দাসের বাড়িতে মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেখানে শোকের ছায়া। অজানা আতঙ্কে রয়েছেন তারা। রূপলাল দাসের ঘনিরামপুর গ্রামে চার শতক জমির বাড়ি। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা ঘর। রূপলালই ছিলেন এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর তিন সন্তানসহ ছয় সদস্যের সংসার তাদের।
পুলিশ, পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করার জন্য মিঠাপুকুর থেকে ভাগনি জামাই প্রদীপ দাস ভ্যানে করে তারাগঞ্জ আসেন। কিন্তু পথ অচেনা হওয়ায় তাকে আনতে বাড়ি থেকে রুপলাল রওনা হয়েছিলেন। সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে 'ভ্যান চোর' সন্দেহে আটকা পড়ে যান তারা। পরে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। এতেই পাল্টে যায় রূপলালের পরিবারের ভাগ্যরেখা।
এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। চোর সন্দেহে পিটুনি দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন রূপলাল ও প্রদীপকে ভ্যানসহ আটক করেন। তাদের ভ্যান থেকে একটি প্লাস্টিকের বস্তা বের করে নাম–পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত কয়েকজন তাদের মারতে উদ্যত হলে, মেহেদী হাসান নামের এক যুবক বাধা দেন এবং পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলেন।
তখন রূপলাল বলেন, "আমি চোর না, ডাকাতও না। মুচি, তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি।" তবে উপস্থিত এক ব্যক্তি উচ্চ স্বরে বলেন, "তুই চোর–ডাকাইতের বাপ।"
এরপর রূপলাল প্রস্রাব করতে চাইলে উত্তেজিত লোকজন ভেবে বসেন তিনি পালাবেন, তাই তাঁকে যেতে দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন ভ্যানের ওপরে বসে ছিলেন প্রদীপ লাল। সেখানে থাকা লোকজন বলেন, "মাল খেয়ে আসছে, অভিনয় করছে।"
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে প্লাস্টিকের বোতল বের করে নাকের কাছে নেন এক যুবক। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, "এ ভাই, দয়া করি আমাকে ধরো" বলেই মাটিতে পড়ে যেতে থাকেন। এরপর দু'জন তাকে কোলে করে সরিয়ে নেন। কিন্তু উপস্থিত লোকজন আবারও রূপলাল ও প্রদীপকে মারধর শুরু করেন।
রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ভোররাত চারটায় তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল থেকে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায়।
রূপলালের গ্রামের প্রবীণ জয়নাল আবেদীন বলেন, "রূপলাল দীর্ঘদিন তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করতেন। সে কখনো কারও সঙ্গে খারাপ কথা বলেননি। এইভাবে মানুষ মারা, এটা তো অমানবিক।"
এদিকে এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেন নিহত রূপলালের স্ত্রী।
এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, "নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে বিকেলে ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। কিছু আলামত পেয়েছি, সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।"