গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: মিথ্যা মামলা, গণ-অভিযোগে হুমকিতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার

গত অক্টোবর মাসে যখন জাহিদুল ইসলাম রাজু আদালতে হাজির হন, তিনি নিজেকে একজন শোকাহত পিতা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি দাবি করেন, তার ১১ বছর বয়সী ছেলে জিহাদ গত বছর কেরানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েক সপ্তাহ পর মারা গেছে। আদালত পুলিশকে নির্দেশ দেন, যে ১১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করতে।
কিন্তু কয়েক মাস পর সত্যিটা সামনে আসে: জিহাদ এখনও বেঁচে আছে।
রাজু স্বীকার করেছেন, হত্যার মামলা দায়ের করার বিনিময়ে তাকে ৩০ লাখ টাকা এবং চার কাঠা জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
এটি একমাত্র ভুল নয়। পুলিশ, আইনজীবী ও জুলাইয়ে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, এর ফলে বিচার ব্যবস্থা মিথ্যা ও সাজানো মামলায় ভরে যাচ্ছে। এসবের অনেকগুলো মামলা অভ্যুত্থানের সময় ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত।
যাত্রাবাড়ীতে ওবায়দুল হকের মৃত্যুর ঘটনা দেখায় কীভাবে এই ব্যবস্থার অপব্যবহার হতে পারে। কুমিল্লার ওবায়দুলকে ৫ আগস্ট গুলি করে হত্যা করা হয়।
তবুও মোহাম্মদ আলী নামে একজন ব্যক্তি একটি মামলা দায়ের করেন, দাবি করেন ওবায়দুল আগের দিন মারা গিয়েছিলেন এবং সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ২০০ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে আসামি করা হয়।
ওবায়দুলের বিধবা স্ত্রী মরিয়ম কিছুদিন পর তার স্বামী হত্যার মামলা করেন। তিনি আলির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে টাকা দাবি করার অভিযোগ তোলেন এবং বলেন, আলি তাদের পরিবারের অচেনা ব্যক্তি।
পুলিশ যখন আলির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, তখন যে নম্বরে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটি অন্য কেউ ধরেছিল এবং অভিযোগ দায়েরের কথা অস্বীকার করে। তদন্ত কর্মকর্তা দুটি মামলা একত্রিত করার আবেদন করেছেন এবং আলিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম স্বীকার করেছেন, 'মামলার নামে মুক্তিপণ আদায়' দীর্ঘদিনের সমস্যা হলেও তা বন্ধে কাজ চলছে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তবুও হাজার হাজার নাম যাচাই করতে থাকায় মামলা পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বাড়াবে এবং জনগণের বিশ্বাস ক্ষুণ্ন করবে।'
যারা সত্যিকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য ন্যায়বিচারের অপেক্ষা আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে, কারণ বিচার ব্যবস্থা অতিরিক্ত চাপের ফলে মামলাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রয়েছে।
দেরিতে বিচার, ব্যবহার হচ্ছে ফাঁকফোকর
বিগত আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ি ছিল বিক্ষোভের একটি বড় কেন্দ্র। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাত্রাবাড়ি ও ডেমরা থানায় মিলিয়ে মোট ১৪২টি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব মামলায় অন্তত ১২টিতে অনিয়ম ধরা পড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় মোট ১ হাজার ৭৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এক লাখেরও বেশি ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তদন্তকারীরা জানান, এক ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে একাধিক মামলা করা হয়েছে। কিছু মামলায় মৃত ব্যক্তিদের আসলে জীবিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। কিছু মামলায় দুই-তিনশো আসামিও রয়েছে। এমনকি অপ্রত্যাশিত অভিযোগে অনেকের নাম এসেছে, যারা ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়; তাদের আসামি করা হয়েছে টাকা নেয়ার জন্য।
তদন্তকারীরা বলছেন, এত বিশাল সংখ্যা হওয়ায় মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
তারা সতর্ক করে বলেছেন, এত বড় পরিমাণ মামলার কারণে সময়মতো তদন্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নাম ও তথ্য যাচাই করতে গেলে আসল ভুক্তভোগীদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়, আর দোষী-নির্দোষ সবাই আইনি জটিলতায় আটকে থাকে।
সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, 'যখন এক মামলায় শত শত আসামি থাকে, তখন দ্রুত তদন্ত সম্ভব হয় না। এতে বিচার নিশ্চিত হয় না, বরং শুধু দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়।'
ভুল আসামিদের জন্য পরিণতি হয় ভয়াবহ—কলঙ্ক, আর্থিক সংকট ও বারবার আদালতে হাজিরার চাপেই বছর কেটে যায়।
মামলাভিত্তিক চাঁদাবাজি চোখে পড়ার মতো
মিথ্যা মামলা শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, অনেক সময় ব্যক্তিগত বিবাদ থেকেও তৈরি হয়।
ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারি জানেন এর দাম। তার পরিবারে বিএনপির সমর্থক, ঢাকায় ২০ বছর বসবাস করছেন।
গত অক্টোবর ফেনীতে এক খুনের চেষ্টার মামলায় তার নাম আসে, যার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আসল কারণ ছিল জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ।
পাটোয়ারি বলেন, 'অকারণে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিবাদ মিটে গেলে মামলা ও হয়রানি একদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।'
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, 'আগে পুলিশ মামলা করার আগে তথ্য যাচাই করত অথবা আদালত তদন্তের নির্দেশ দিত। এখন আদালত যাচাই-বাছাই ছাড়া তাৎক্ষণিক মামলা রেজিস্ট্রার করার আদেশ দেয়।'
এই পরিবর্তন মিথ্যা অভিযোগ এবং চাঁদাবাজির সুযোগ বাড়িয়েছে।