মাত্র ৬ মাসেই ২০০০ কর্মসংস্থান তৈরি করল প্রাণ-আরএফএলের বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল

কার্যক্রম শুরু করার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল লিমিটেডে দুই হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ নারী।
রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় ২৬ একর জায়গায় গড়ে ওঠা এই কারখানায় বর্তমানে প্রতিমাসে প্রায় ছয় লাখ জোড়া জুতো ও ব্যাগ তৈরি হচ্ছে; যার অধিকাংশ পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হয়।
এই কারখানা থেকে প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে এবং কোম্পানিটি সম্প্রতি বড় পরিসরে সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছে।
কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, কারখানায় এখন বিভিন্ন ধরনের জুতা, লাগেজ এবং স্টোরেজ ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে তৈরি পোশাক উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ কারখানা এলাকায় বিশ্বমানের একটি আধুনিক কল সেন্টার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগামী দুই বছরে এই কারখানায় ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে এ অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।'
এই কারখানার জায়গাটি আগে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা রাজশাহী টেক্সটাইল মিলের ছিল। ২২ বছর ধরে এই মিল বন্ধ ছিল। এরপর প্রাণ-আরএফএল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল কর্পোরেশন (বিটিএমসি) থেকে জমি লিজ নিয়ে এটি চালু করে।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রাণ-আরএফএল এই কারখানা জায়গাটি পুনরুজ্জীবিত করে পরিত্যক্ত একমাত্র শেড সংস্কার করে উৎপাদন শুরু করে।
কামরুজ্জামান বলেন, 'পুরনো যন্ত্রপাতির অধিকাংশই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছিল, তাই তা কাঁচা লোহা হিসেবে বিক্রি করতে হয়েছে। যেহেতু মিলটি টেক্সটাইল উৎপাদনের জন্য তৈরি, তাই আমাদের জুতা ও ব্যাগ তৈরির উপযোগী নতুন যন্ত্রপাতি বসাতে হয়েছে।'
তিনি আরও জানান, কারখানায় ১০০ টাকার স্যান্ডেল থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার প্রিমিয়াম জুতো পর্যন্ত তৈরি হয়। তিনি বলেন, 'কাঁচামাল আমরা দেশি-বিদেশি উভয় স্থান থেকে আনি, আর উৎপাদন ধাপে ধাপে করা হয় যাতে দেশি ও বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ হয়।'
আগামীতে তৈরি পোশাক উৎপাদন শুরু করার পাশাপাশি একটি আধুনিক টেলিমার্কেটিং সেন্টারও প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানির, যা নারীদের জন্য বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে।
কামরুজ্জামান বলেন, বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল লিমিটেডের পাশাপাশি রাজশাহীর অন্যান্য কারখানায়, বিশেষ করে বিসিক শিল্প এলাকায় তাদের পণ্য তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সে লক্ষ্যে কাজ করছে। কারখানার সকল কর্মী রাজশাহীর স্থানীয়, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ নারী।'
বর্তমানে কারখানায় দুই হাজার স্থানীয় শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের অনেকেই সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের।
গোদাগাড়ীর বাসিন্দা ও কারখানার প্রোডাকশন কর্মী শঙ্করী রাণী বলেন, তার চাকরি পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী কর্মকার, কিন্তু তার আয় সংসার চালাতে যথেষ্ট ছিল না। এখানে কাজ করে আমি পরিবারের খরচ ও দুই মেয়ের পড়ালেখার জন্য সাহায্য করতে পারি। আমাদের শিফট সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, এক ঘণ্টার মধ্যাহ্ন বিরতি সহ।'
কারখানার ট্রেনিং এক্সিকিউটিভ নাহেদা আক্তার নিতু চার মাস আগে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'ঢাকায় কাজ করতাম, কিন্তু পরিবার চাইছিল রাজশাহীতে থাকি। কারখানা খুলতেই আমি দেরি না করে যোগ দিয়েছি।'
দুই হাজার কর্মসংস্থান অর্জনের মাইলফলক উপলক্ষে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ শনিবার কারখানা প্রাঙ্গণে '২ হাজার কর্মসংস্থান উদযাপন; লক্ষ্য ১২ হাজার' শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে শ্রম সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী, রাজশাহীর পুলিশ সুপার ফারজানা ইসলাম, বিটিএমসি ম্যানেজার নুরুল আলমসহ অন্যান্য স্থানীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এই উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা পুনরায় চালু করে এত দ্রুত দুই হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি শুধু শিল্পপুনরুজ্জীবন নয়, একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা।'
তিনি আরও বলেন, 'গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকায় কাজ না থাকায় অনেক মানুষ শহরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণ-আরএফএল দেখাচ্ছে, কীভাবে অঞ্চলে শিল্পায়ন করে টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।'
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বড়। আমরা বিশ্বাস করি, কাজের জন্য ঢাকায় যাওয়া প্রয়োজন এমন দিন শেষের দিকে।'
তিনি বলেন, 'বরং আমরা ভবিষ্যতে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠা করে লোকজনকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় চাকরি দিতে চাই। রাজশাহীতে শ্রমনিষ্ঠ শিল্পে বিনিয়োগ করে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করছি।'
তিনি আরও জানান, এই কারখানাটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, টেকসই একটি গ্রীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে পরিণত হবে। সব পণ্য রপ্তানিমুখী হবে।
আহসান খান বলেন, 'আমরা টেলিমার্কেটিং সেন্টারের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে নারীদের জন্য আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছি।'