আটবছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ, জেলেপল্লির চুলায় জ্বলছে না আগুন

প্রতিক্ষণ নানা ঝুঁকি ও শঙ্কা নিয়ে দিন চলে তাদের। নিরাপত্তার বেড়াজালে আটকে আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। না পারছে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়তে, না পারছে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেও মুক্তির পথ খুঁজছে তারা।
বলছি, বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরসংলগ্ন টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্ত এলাকার মানুষের কথা—যাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনটুকুও নেই।
মিয়ানমারের দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষে সবসময় আতঙ্কে থাকে সীমান্তবাসী। প্রতিবেশী দেশ থেকে ছোড়া মর্টারশেলে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন, নিহত হন রোহিঙ্গাও। আহত হন সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ। মাইন বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষিজীবীরাও। সময় সময়ে বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সীমান্তজুড়ে চলে অপহরণ, মাদক, মানবপাচার ও অস্ত্র পাচার। সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করেছে সরকার। কিন্তু এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সীমান্তের সাধারণ মানুষের জীবনধারণকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজারেরও বেশি জেলে পরিবার।

টেকনাফের হ্নীলা জলদাস পাড়ার ৭০ বছর বয়সী সমপ্তি দাস। ৯৬ বছর বয়সী মাকে নিয়ে জাল বুনে কোনো মতে দুমুঠো ভাত জোগাড় করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জালের আর চাহিদা নেই। তাই জাল তৈরির কাজও বন্ধ।
সমপ্তি দাস বলেন, ''একসময় এই জেলেপল্লি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে ভরপুর। বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে এসে আয়-রোজগার করতেন। নাফ নদী থেকে ধরা তাজা মাছ ও শুঁটকি সরবরাহ হতো টেকনাফ, কক্সবাজারসহ সারা দেশে। তখন ছিল না কোনো অভাব-অনটন। চুলায় আর আগুন জ্বলে না। নিরাপত্তার অজুহাতে ৮ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ।''
শুধু সমপ্তি দাস নন, তার মতো হ্নীলা জলদাস পাড়ার শত শত পরিবারই এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
একটি ঝুপড়িঘরের মেঝেতে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন অসুস্থ জেলে নবী হোসেন। স্ত্রী মোস্তফা খাতুন বলেন, ''ওষুধ কেনার টাকাও নেই। মাছ ধরা বন্ধ মানেই আয়-রোজগারও বন্ধ।''
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে নাফ নদী হয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। সেই সময় ঢল ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়, যার আওতায় নাফ নদীতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু ৮ বছরেও সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। নাফ নদীতে মাছ ধরা তদারক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গনি বলেন, 'দীর্ঘ আট বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি দুই শতাধিক নৌযান ও মাছ ধরার জাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।'
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলী আহমদ বলেন, 'টেকনাফের প্রায় ৫ হাজার জেলে পরিবার নাফ নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিরাপত্তার নামে সামরিকীকরণের কারণে ৮ বছর ধরে তারা নদীতে নামতে পারছে না। মাছ ধরা বন্ধ হলেও সীমান্তে অপরাধ বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। জেলে পরিবারগুলো এখন ধারদেনা ও সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সরকার যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে জেলেপল্লির মানুষ না খেয়ে মরবে।'
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, 'নিরাপত্তাজনিত জটিলতায় সীমান্তবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলে তাদের অন্যত্র পুনর্বাসন ও আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া জরুরি।'
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, 'জেলে পরিবারগুলোর মানবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ৫ আগস্ট থেকে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ অংশে দিনের বেলায় সীমিতভাবে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে নাফ নদীর অন্য কোথাও এখনো মাছ ধরা নিষিদ্ধ।'