বিআরটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব একনেকে নাকচ, ত্রুটিপূর্ণ নকশা তদন্তের নির্দেশ

দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে থাকা 'গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট' বা গাজীপুর-এয়ারপোর্ট বাস র্যাপিড ট্রান্সিট (বিআরটি) প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব বাতিল করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরিকল্পনায় দুর্বলতা ও নকশায় গুরুতর ত্রুটির কারণে একনেক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কমিটি আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ এই প্রকল্পের প্রাথমিক পরিকল্পনা, নকশা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে।
শনিবার (২৭ জুলাই) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ১২তম এবং চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম একনেক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, বিষয়টি তদন্তে দেশি-বিদেশি আইন ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে প্রকল্পটি কীভাবে এগোবে।
২০১২ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের মূল ধারণা অনুযায়ী, গাজীপুর-টঙ্গী-এয়ারপোর্টের ব্যস্ত এলাকায় একটি দ্রুতগামী, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল এ প্রকল্পের লক্ষ্য।
কিন্তু ১২ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, প্রকল্পের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে, এবং বর্তমানে বিআরটি সেবার জন্য বিশেষ বাস কেনার প্রস্তুতি চলছে।
সভায় প্রকল্পের চতুর্থ সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, যেখানে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৫৪.৫৭ শতাংশ বা ২,৩২৯ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬,৫৯৭.৩২ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মূল প্রকল্প ব্যয় ছিল ২,০৩৯.৮৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর বাড়ানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তবে উভয় প্রস্তাবই সভায় নাকচ করা হয়েছে।
প্রকল্পের ত্রুটির কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "এই প্রকল্পটি এতটাই অপরিকল্পিত যে তা কল্পনার বাইরে। উত্তরা অঞ্চলে প্রকল্পটি হলে কোনো যাত্রী হেঁটে রাস্তা পার হতে পারবে না। অথচ এই অঞ্চলে তৈরি পোশাকশিল্প রয়েছে। ২০১২ সালে প্রকল্প শুরু হওয়ার সময় এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।"
তিনি বলেন, "দুটি এলাকার মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া যেতে পারতো এমন কোনো করিডোরে, যেখানে মাঝখানে বসতি নেই। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যা অসংগতিপূর্ণ ও অদ্ভুত।"
উপদেষ্টা আরও বলেন, "এখানে অনেক এস্কেলেটর ও লিফট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব একবার নষ্ট হলে কখন মেরামত হবে, তা বলা যায় না। এমনকি এস্কেলেটর স্থাপন করা হয়েছে ফুটপাতে, যার ফলে পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে না পেরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হবেন।"
"উত্তরা এলাকায় অসংখ্য স্কুল-কলেজ রয়েছে। সেখানে মাত্র ১০টি ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়," বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, "যদি বিদেশিরা না বুঝে এই নকশা করে থাকেন, তবুও স্থানীয় কর্মকর্তাদের সেটা বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। নকশায় যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভুল থাকে, তাহলেও বাস্তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, কারণ আমরা এমন অনেক প্রকল্পের চুক্তিপত্র দেখেছি যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে—নকশায় ভুল থাকলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।"
তবে তিনি জানান, "সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই প্রকল্পে বিআরটি লেনসহ সব লেন সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে, যাতে জনগণ দুর্ভোগে না পড়ে।"
তিনি আরও বলেন, "পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে—বিআরটি লেনে টোলের বিনিময়ে বাস চালুর সুযোগ রাখার, যাতে প্রকল্প ব্যয়ের কিছুটা পুনরুদ্ধার করা যায়। তবে আপাতত সরকার সব লেনই সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখবে।"
বিআরটি প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "এই প্রকল্পটি একটি 'চাপানো প্রকল্প', যেখানে কোনো পেশাদারিত্বের ছাপ নেই। যারা এই প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা এখনো বিশ্বাস করেন—আরও কিছু টাকা ব্যয় করলে বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা কোনো দিনই সম্ভব হবে না।"
তিনি বলেন, "এই প্রকল্পে নীতিগত ভুল রয়েছে। ভবিষ্যতে এটি মারাত্মক যানজটের কারণ হবে—এমন আশঙ্কা আমরা বারবার জানিয়েছিলাম। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বুয়েট ও ভারতের আহমেদাবাদের সিইপিটি ইউনিভার্সিটি দুই বছরের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর প্রকল্প থেকে সরে আসে।"
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, "প্রায় দুই বছর ধরে আমরা বিআরটি কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। শেষে বাধ্য হয়ে আমরা (বুয়েট ও সিইপিটি ইউনিভার্সিটি) প্রকল্প থেকে সরে যাই, যদিও সিইপিটি ভারতে সফল বিআরটি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান।"
তিনি, "যেমন জামা বানানোর আগে কাপড়ের মাপ নেওয়া হয়, তেমনি বিআরটির সম্ভাব্য চাহিদা যাচাই না করেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে বিআরটি লেনের জায়গা রাখতে গিয়ে নন-বিআরটি লেন সংকুচিত হয়ে গেছে।"
"এই করিডোর একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও শ্রমনির্ভর অঞ্চল। শিল্প এলাকার প্রকৃত চাহিদা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যার ফলে এই প্রকল্পের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক হবে। এই বিআরটি করিডোর টেকসই হবে না। জোরপূর্বক চালু করতে গেলে শ্রমিক ও শিল্প সংশ্লিষ্ট পরিবহন—যেমন ট্রাক, লরি ইত্যাদিও ঝুঁকির মুখে পড়বে," বলেন তিনি।
শামসুল হক আরও বলেন, "এই প্রকল্প যারা নিয়েছে তারা মারাত্মক ভুল করেছে।"
জুলাই শহীদদের পরিবারের জন্য গৃহায়ণ প্রকল্পের প্রস্তাবও নাকচ
এদিকে, একনেক সভায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে ফ্ল্যাট প্রদানের লক্ষ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
প্রকল্পটির আওতায় রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে ৭৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬টি ১৪ তলা এবং ১০টি ১০ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব ছিল।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক প্রকল্প প্রস্তাব আসছে। সরকার এসব প্রকল্প আগে সমন্বয় করবে। এরপর সমীক্ষার মাধ্যমে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে ধাপে ধাপে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "এই কারণেই একনেক সভায় শহীদ পরিবারের জন্য ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি, প্রস্তাবিত এই প্রকল্পসহ জুলাই কেন্দ্রিক সব প্রকল্পের ব্যয় সরকার যাচাই করে দেখবে।"
৮,১৪৯ কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন
বিআরটি ও গৃহায়ণ প্রকল্প প্রস্তাব নাকচ করা হলেও, একনেক সভায় মোট ৮,১৪৯.৩৮ কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ২,৮৪০.৩৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও।
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয়ের মধ্যে ৮,০৫৮.৭৭ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে আসবে ১৪৩.৩৩ কোটি টাকা, আর সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে বাকি ৫২.৭২ কোটি টাকা।
অনুমোদিত ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ৬টি নতুন, ৪টি সংশোধিত এবং ২টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে—তবে এগুলোর ব্যয় বাড়ানো হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, গত বছরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনকে একটি 'মাস্টার প্ল্যান' প্রণয়নের জন্য বলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, "এই বৃহৎ প্রকল্পের আওতায় নতুন একাডেমিক ও আবাসিক ভবন, ছাত্রী ও ছাত্রদের জন্য পৃথক ডরমিটরি, একটি স্টেডিয়াম এবং সুইমিং পুল নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরও জানান, একনেক সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে—ছাত্রীদের জন্য আবাসন সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি রাখতে হবে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনা—যেমন এসএম হল এবং কার্জন হল—যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
তিনি বলেন, "এই প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। আশা করি, এটি সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
একনেক সভায় যেসব প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ (২য় বার সংশোধিত, চতুর্থ মেয়াদ বৃদ্ধি) প্রকল্প, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২০টি (১২টি নতুন এবং ৮টি পুনর্নির্মাণ) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন প্রকল্প, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য লজিস্টিকস ও ফ্রেইট রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা উন্নয়ন (প্রস্তাবিত ২য় বার সংশোধিত) প্রকল্প, গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প, বাহাদ্দারহাট বাদ্রাইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন (৩য় বার সংশোধিত) প্রকল্প, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার প্রকল্প, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে ডিএসসিএসসি'র অফিসার্স মেস ও বিওকিউ নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প, উপজেলা পর্যায়ে নারীদের আয়ের উৎসমুখী প্রশিক্ষণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ভবন সম্প্রসারণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ (১ম সংশোধিত, চতুর্থ মেয়াদ বৃদ্ধি) প্রকল্প, কন্দাল ফসল গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প এবং বিপিডিবির বিতরণ অঞ্চলে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রকল্প (১ম সংশোধিত)।