প্রধান উপদেষ্টার জাকার্তা সফর: জিটুজি পর্যায়ে কয়লা আমদানি ও সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ চাইবে ঢাকা

ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা খনিতে বিনিয়োগের সুযোগ খোঁজা ও দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পার্টামিনা-র জন্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে প্রবেশের পথ সুগম করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
টিবিএসের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, আগস্টের মাঝামাঝিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাকার্তা সফরে এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাবে।
বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জ্বালানি কূটনীতিতে এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ স্থিতিশীল জ্বালানি উৎস নিশ্চিতের পাশাপাশি মারাত্মকভাবে ভারসাম্যহীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে এই সফরের প্রস্তুতি শুরু করেছে। জ্বালানি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতের আলোচ্যসূচি সমন্বয়ের লক্ষ্যে ৭ জুলাই সচিবের (দ্বিপাক্ষিক—পূর্ব ও পশ্চিম) সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের আলোচনা অনুসারে, বাংলাদেশ সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) চুক্তির আওতায় সরাসরি ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির সুযোগ খুঁজবে।
এছাড়া সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ), মুরিং অবকাঠামো ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে ইন্দোনেশিয়ার বিনিয়োগও চাইবে ঢাকা।
ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে ২০ জুলাইয়ের (আজ) মধ্যে এসব বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
জিটুজি চুক্তির আওতায় কয়লা আমদানি
গতকাল টিবিএসকে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বাংলাদেশ জিটুজি পর্যায়ে সরাসরি কয়লা আমদানি এবং ইন্দোনেশিয়ার কয়লা খনিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে দরপত্র নিয়ে জটিলতায় পড়ছি—কারসাজির অভিযোগ, দাম বাড়িয়ে দেখানো এবং নিম্নমানের কয়লার মতো সমস্যা রয়েছে। জিটুজি ব্যবস্থা এই অদক্ষতাগুলো এড়াতে পারে।' তিনি আরও নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
জ্বালানি সরবরাহে আগ্রহী ইন্দোনেশিয়ার তেল কোম্পানি
জ্বালানি বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের জ্বালানি বাজারে প্রবেশের চেষ্টার অংশ হিসেবে পার্টামিনা-র কর্মকর্তারা এদেশের জ্বালানি সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারটি সৌদি আরব, কাতার ও আবুধাবির মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিপিসির তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭ লাখ টন জ্বালানি আমদানি করেছে। এর মধ্যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই এসেছে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে সক্রিয়ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজছে বাংলাদেশ। নিকটবর্তী অবস্থান ও ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে ইন্দোনেশিয়াকে কার্যকর বিকল্প মনে করা হচ্ছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে বাংলাদেশ পেট্রল, মেরিন ফুয়েল ও লুব্রিকেন্ট সরবরাহের জন্য পার্টামিনাকে সম্ভাব্য সরবরাহকারী বিবেচনা করছে। ফাওজুল কবির খান বলেন, 'আমাদের তেল আমদানি মধ্যপ্রাচ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল; অঞ্চলটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। আমরা সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সরবরাহের নতুন পথ খুঁজছি।'
নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, পার্টামিনার এই আগ্রহ দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতায় নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, যা সাধারণ বাণিজ্য সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপ দেবে। তবে পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করেছেন, ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর সমান্তরাল প্রচেষ্টা ছাড়া এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি একটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
এফএসআরইউ ও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসার পর সরকার বেসরকারি খাতকে কয়লা খনিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে। ফাওজুল কবির খান বলেন, 'আমরা এফএসআরইউতেও ইন্দোনেশিয়ার বিনিয়োগ চাইছি। ইন্দোনেশিয়া একটি কয়লা খনিতে যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে; আমরা এখন সেই পথটি খতিয়ে দেখছি। বিনিয়োগকারী সরকারি না বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হবে, তা নিয়েও আমরা ভাবছি।'
বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বাংলাদেশ মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত ৫০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আগে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বাস্তবায়নে অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্য নিয়েছে। বাংলাদেশ কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও পিটি পাওয়ারের মধ্যে ১৫ জুলাই স্বাক্ষরিত একটি এমওইউতে এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই যৌথ উদ্যোগের জন্য জমি সরবরাহ করবে বাংলাদেশ।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, 'তেল সরবরাহ ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল পরিচালনায় একটি ইন্দোনেশীয় কোম্পানির আগ্রহের প্রস্তাবও বাংলাদেশ পর্যালোচনা করছে।'
পার্টামিনা ইতিমধ্যে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের (ওঅ্যান্ডএম) জন্য দরপত্র জমা দিয়েছে, যা এখন বিপিসির দরপত্র কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন করছে।
জ্বালানি সহযোগিতা জোরদার করতে ২০২৩ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদির মধ্যে স্বাক্ষরিত এমওইউয়ের আলোকে একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই এমওইউতে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সরবরাহ এবং বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ও বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে ভোলা থেকে বরিশাল পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনে ইন্দোনেশিয়ার সম্ভাব্য বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া বাণিজ্য পরিস্থিতি
বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন কয়লা আমদানি করে, যার মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে এই বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের প্রতিকূলে। ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়ায় ৬৪ মিলিয়ন ডলারেরও কম মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে।
বিপরীতে একই সময়ে ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশে প্রায় ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য পাঠিয়েছে, যার মধ্যে প্রধানত পাম তেল, কয়লা ও পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম রয়েছে।
বাণিজ্য তথ্য বলে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বার্ষিক ১৩.৬ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা ২০১৮ সালের ১.৮৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৩.৫৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তালিকা সীমিত, যা মূলত নিট টি-শার্ট, পাটের সুতা ও কয়েকটি পোশাক পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।