কাদা–গর্তে দুর্বিষহ যশোর–খুলনা মহাসড়ক, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম

বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে যশোর–খুলনা মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়ে সড়কটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এতে ভারী যানবাহন চলাচল ও যাতায়াত মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যদিও বর্তমানে সড়কের সংস্কারকাজ চলমান।
ক্ষতিগ্রস্ত অংশে দুর্ঘটনা এড়াতে যানবাহনগুলোকে ধীরগতিতে চলতে হচ্ছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট এবং ট্রিপে সময় লাগছে স্বাভাবিকের চেয়ে ২–৩ দিন পর্যন্ত বেশি।
এতে যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবহন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এসব জেলার স্থল ও নদীবন্দর ব্যবহার করে এই মহাসড়ক দিয়েই পণ্য পরিবহন করা হয়, যার ওপর নির্ভরশীল বিস্তৃত এলাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই মহাসড়কের যশোরের বসুন্দিয়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে যান চলাচল হয়ে উঠেছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। টানা বর্ষণে সড়কে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। ফলে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে এবং দুই প্রান্তে প্রায়ই লেগে থাকছে দীর্ঘ যানজট।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শত শত গর্ত আর কাদার কারণে এই সড়ক এখন 'মরণফাঁদে' পরিণত হয়েছে। ভরা মৌসুমে সার পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় কৃষকরাও পড়েছেন বড় ধরনের সমস্যায়।
এদিকে, সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে; পুরো কাজ শেষ হতে দেড় বছর লাগবে।
যশোর–খুলনা মহাসড়ক দেশের ব্যস্ততম সড়কগুলোর মধ্যে একটি। এটি বেনাপোল স্থলবন্দর, যশোরের নওয়াপাড়া নদীবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান রুট। এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় হাজার হাজার পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে।
২০১৭ সালে তৎকালীন সরকার মহাসড়কটির সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল। প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০২৩ সালে তা শেষ হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ে। এরপর থেকে সংস্কারকাজ চললেও তা টেকসই হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের ভোগান্তির কারণে নওয়াপাড়া নদীবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ভরা মৌসুমে সার পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় কৃষকরাও পড়েছেন সংকটে।
প্রেমবাগ এলাকার বাসিন্দা আবদুস সবুর বলেন, "মহাসড়কের পাশেই আমাদের গ্রাম। প্রতিদিন এই রাস্তা ব্যবহার করি। গত তিন–চার বছর ধরে উন্নয়নকাজ চলছে, কিন্তু এক পাশে কাজ শেষ হতেই অন্য পাশে রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সামনে চেঙ্গুটিয়া বাজারে তিনটি স্কুল-কলেজ রয়েছে। হাঁটুসমান কাদার কারণে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতও বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত গাড়ি যানজটে আটকে থাকে। আমরা দ্রুত এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই।"
ট্রাকচালক নজরুল ইসলাম বলেন, "রূপদিয়া থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত সড়কে শুধু খানাখন্দ আর কাদা। চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত অংশ তো একেবারে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গাড়ির এক্সেল ভেঙে যাচ্ছে, উল্টে রাস্তার পাশে পড়ে যাচ্ছে। এই রুটে ট্রিপ নিলে দুই–তিন দিন পর্যন্ত জ্যামে আটকে থাকতে হয়।"
আরেক ট্রাকচালক জালাল উদ্দিন বলেন, "সড়কের অবস্থা এতটাই খারাপ যে আমাদের ট্রাকের স্প্রিং ভেঙে গিয়ে কাদায় আটকে গিয়েছিল। পরদিন দুপুর পর্যন্ত ট্রাক সরাতে পারিনি।"
স্থানীয় বাসিন্দা রাজীব হোসেন বলেন, "২০২২ সাল থেকে এখানে সংস্কারকাজ চলছে। কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও কাজের মান ভালো হয়নি। দুর্নীতির কারণে সড়কের সর্বত্র ভাঙা-খানাখন্দ।"
"আশপাশে বহু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা থাকলেও মানুষের চলাচল সীমাহীন কষ্টকর। রোগী নিয়ে যাতায়াত করতে হলে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। তাই টেকসইভাবে সড়ক নির্মাণ জরুরি," বলেন তিনি।
নওয়াপাড়া শিল্পনগরীর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপের ম্যানেজার রাজু আহমেদ বলেন, "নওয়াপাড়া কেবল একটি নৌবন্দর নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা। এখানকার বন্দর দিয়ে দেশের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানিকৃত সার খালাস হয়। কিন্তু মহাসড়কের করুণ অবস্থায় সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চেঙ্গুটিয়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তা এতটাই নষ্ট যে ট্রাকগুলো মাল নিতে চাইছে না।"
নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নূরে আলম বাবু বলেন, "টানা বর্ষণে রাস্তার অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়েছে। এখন মালবাহী ট্রাক চলাচলই করতে পারছে না। ফলে নওয়াপাড়া নদীবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রায় অচল। সড়ক দ্রুত সংস্কার না করলে সার ও খাদ্যশস্য সরবরাহ ব্যাহত হবে। সময়মতো সার না পেলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে এবং দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।"
সড়ক ও জনপথ বিভাগের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, "মহাসড়কের মাটির গুণগত মান ভালো না। আবার অতিরিক্ত ওজনের যানবাহন চলাচলের কারণে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। বুয়েটের পরামর্শে ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ৪ কিলোমিটার শেষ হয়েছে, ২.৩ কিলোমিটারে কাজ চলছে। আরও আট কিলোমিটার ঢালাই হবে। সব মিলিয়ে দেড় বছর সময় লাগবে।"
সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, যশোর শহরের পালবাড়ি মোড় থেকে অভয়নগরের রাজঘাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে ইতোমধ্যে ৩২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। নতুন করে আরও ১৭২ কোটি টাকার কাজ চলছে।