হাসিনার গুলির নির্দেশ: বিবিসি যেভাবে ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং যাচাই করেছে

গত বছর দেশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন দমনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে 'প্রাণঘাতী অস্ত্র' ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিবিসি বাংলা এবং বিবিসি আই-এর যৌথভাবে যাচাই করা একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
অনলাইনে ফাঁস হওয়া এই রেকর্ডিংটিতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, আন্দোলনকারীদের 'যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে'।
অজ্ঞাত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে হাসিনার এই কথোপকথনের অডিও সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
জাতিসংঘের তদন্তকারী দলের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই-আগস্টের ওই আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারান।
বর্তমানে হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার চলছে, সেখানে এই অডিও রেকর্ডিংটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছেন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা।
তবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে অবস্থানরত হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, 'টেপ রেকর্ডিংটির সত্য কি না, তা আমরা নিশ্চিত করতে পা্রছি না।'
এই টেপ রেকর্ডিং হাসিনার কোনো 'বেআইনি উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটায় না' বলেও মন্তব্য করেন তারা।
যেভাবে অডিওটি যাচাই করা করেছে বিবিসি
বিবিসিকে একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ১৮ জুলাই ফোনকলটি হয়েছিল। শেখ হাসিনা তখন ঢাকার গণভবনে অবস্থান করছিলেন।
অডিওটি ফাঁস করা হয় চলতি বছরের মার্চে। তবে কে ফাঁস করেছে, তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।
বিবিসি কয়েক ধাপে এই অডিও রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেছে।
প্রাথমিক শনাক্তকরণ
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠস্বরটির সঙ্গে শেখ হাসিনা কণ্ঠের মিল শনাক্ত করেছে।
স্বাধীন বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ
বিবিসি আলাদাভাবে রেকর্ডটির নিরপেক্ষ যাচাইয়ের জন্য সেটি ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান 'ইয়ারশট'-এর কাছে পাঠায়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এতে কোনো সম্পাদনা, কাটাছাঁট বা কৃত্রিম শব্দ সংযোজনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং এটি নকল বা কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়াও খুবই অস্বাভাবিক।
• ইয়ারশট জানায়, রেকর্ডটি সম্ভবত কোনো কক্ষে স্পিকারে ফোনালাপ চালিয়ে রেকর্ড করা হয়েছিল। কারণ এতে ফোনালাপের নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড পাওয়া গেছে।
• ইয়ারশট রেকর্ডজুড়ে 'ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি'ও চিহ্নিত করে, যা সাধারণত বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের সঙ্গে রেকর্ডিং ডিভাইসের সংযোগ থেকে তৈরি হয় এবং এটি প্রমাণ করে যে অডিওটি সম্পাদিত নয়।
• ইয়ারশট হাসিনার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে কণ্ঠের ছন্দ, উচ্চারণ, নিশ্বাসের শব্দ এবং শব্দের 'নয়েজ ফ্লোর' পরখ করে কোনো কৃত্রিমতা খুঁজে পায়নি।
ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, 'এই রেকর্ডগুলো শেখ হাসিনার ভূমিকাকে প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট, সঠিকভাবে যাচাইকৃত এবং অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।'
এদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, গত বছরের জুলাই ও আগস্টের সহিংসতায় তাদের ভূমিকার জন্য ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মুখপাত্র বলেন, 'কিছু প্রাক্তন পুলিশ সদস্যের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ফলে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পুলিশ পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেছে।'