সংস্কারের কথা বললেও ২৯৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে জামায়াত

মৌলিক সংস্কারের দাবিতে অনড় অবস্থান বজায় রাখলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সংস্কারকে গুরুত্ব দিলেও দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। প্রস্তুতির সঙ্গে দলটির কাছ থেকে বিভিন্ন সময় আবার সংস্কারভিত্তিক বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াত দাবি করে আসছে, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও নির্বাচনি সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে গত বছরের নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রার্থী ঘোষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দলটি।
গত শুক্রবার রংপুর বিভাগের ৩৩টি সংসদীয় আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আয়োজিত এক জনসভা থেকে এই তালিকা ঘোষণা করেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম।
এর আগে, চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ শহরের উবাই পার্কে আয়োজিত নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতের সমাবেশে ২৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এরপর টাঙ্গাইলের ৮টি, নেত্রকোনার ৫টি এবং ময়মনসিংহ জেলার ১১টি আসনের মধ্যে ১০টি আসনে প্রার্থীর নাম প্রকাশ করা হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি সিলেট মহানগর জামায়াতের অফিসে অঞ্চলভিত্তিক এক বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার ২১টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
এর আগে ও পরে আরও কয়েক দফায় বিভিন্ন জেলার আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি।
নির্বাচনের এখনও বেশ কিছু সময় বাকি থাকলেও কেন এত আগেই প্রার্থী ঘোষণা করা হচ্ছে—এ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা আব্দুল হালিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তৃণমূলের মতামত ও সংসদীয় বোর্ডে আলোচনা করেই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। এটি এখনো প্রাথমিক নির্বাচন। তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।"
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে—তা পূরণে নিজেদেরকে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে জামায়াত।
ভোটপ্রাপ্তির দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্ভাবনার নতুন সুযোগ দেখছে জামায়াতে ইসলামী। একসময়ে বিএনপির মিত্র হলেও এখন দলটি ছোট ছোট ইসলামী দলগুলোর সমর্থন নিয়ে একটি ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
গত ২৮ জুন ঢাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত এক মহাসমাবেশে অংশ নেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। সেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নিযামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কয়েকটি ইসলামী দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
যদিও এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক জোটভুক্তির বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়, তবে সম্প্রতি ইসলামী জোটভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রমে দলটির উপস্থিতি পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জামায়াত নেতারা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে সব ইসলামী ভোট এক প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সংস্কার দাবি, একইসঙ্গে কৌশলগত প্রস্তুতি
নির্বাচনি প্রচার জোরদার করলেও জামায়াতের অবস্থান স্পষ্ট—মৌলক সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না।
"বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়," শুক্রবার এমন মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি প্রশ্ন রাখেন, "এই পরিস্থিতিতে কী ধরনের নির্বাচন হতে পারে?"
শুক্রবার নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান আরও বলেন, "মৌলিক সংস্কার ছাড়া দেশে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য আগে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, আর সেই পরিবেশ তৈরির জন্যই আমরা মৌলিক সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।"
এদিকে, মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও, একের পর এক প্রার্থী ঘোষণার বিষয়টি দলের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না—এমন প্রশ্নে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটা সাংঘর্ষিক না। প্রয়োজনে আমরা নির্বাচন করব না। তবে নির্বাচন কোনো দুই মাস বা এক সপ্তাহের প্রস্তুতির বিষয় না—আমরা সারাবছর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি নিই। প্রার্থী ঘোষণা আমাদের নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ।"
দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, "জনগণকে জানানোর জন্যই প্রার্থী তালিকা আগেভাগে ঘোষণা করা হচ্ছে। আমাদের দলে কেউ নিজ থেকে নিজের জন্য ভোট চায় না। আগেই প্রার্থী না জানালে তারা মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে পারে না। কিছু সিনিয়র নেতা আছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, তাদের আসন মোটামুটি নির্ধারিত। তবে কিছু আসনে নতুন প্রার্থী থাকায় আগেই তাদের নাম জানানো হচ্ছে।"
প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় নিয়ে আপত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, "আমি মনে করি না, আমরা খুব আগে প্রার্থী ঘোষণা করছি। ফ্যাসিবাদের সময় আমরা নির্বাচনে যাইনি, সেই কারণে এ প্রক্রিয়া থেকেও অনেক দূরে ছিলাম। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, জাতি নির্বাচনমুখী। প্রার্থীতার তালিকা পরিবর্তনও হতে পারে।"
বিএনপির ঘাঁটিতে জামায়াত প্রার্থী
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফেনী-১ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, তিনি এবার এ আসনে প্রার্থী হবেন কি না—তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে ইতোমধ্যে এই আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য অ্যাডভোকেট কালাম আহমেদকে ফেনী-১ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে।
বগুড়া-৬ (সদর) আসনেও আগে প্রার্থী হয়েছিলেন বেগম জিয়া। সর্বশেষ নির্বাচনে এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এবার সেই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত—প্রার্থী হচ্ছেন দলটির কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও বগুড়া শহর জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আবিদুর রহমান সোহেল।
ঠাকুরগাঁও-১ আসনটি মির্জা ফখরুলের 'হোম কনস্টিটুয়েন্সি' হিসেবেই পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির হয়ে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছেন তিনি। এবার সেখানে জামায়াতের প্রার্থী হচ্ছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মো. দেলোয়ার হোসেন।
তবে বিএনপি বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না। গতকাল দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, "সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে জামায়াত।"
রিজভী বলেন, "একদিকে নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আরেকদিকে আবার জোরেশোরে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। আমরা আপনার অতীত জানি। এক সময় আপনি স্বৈরাচারের অধীনে শেখ হাসিনার পথ অনুসরণ করে কোনো দ্বিধা ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।"
জামায়াত আমিরের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে ব্যঙ্গ করে রিজভী আরও বলেন, "উনি এমনভাবে কথা বলেছেন যেন উনি পরিবেশকর্মী, যিনি নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। হঠাৎ করে আপনি পরিবেশবাদী হয়ে গেলেন! যদি আপনি পরিবেশ নিয়ে এতই উদ্বিগ্ন হন, তবে বৈশ্বিক পরিবেশ সংকটের বিপর্যয়ের দিকেই মনোযোগ দিন।"