নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণে বিশেষ কমিটি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একমত রাজনৈতিক দলগুলো

জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের অষ্টম দিনের (২ জুলাই) আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছে, যা সংবিধানে যুক্ত থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে, তবে এর গঠন, মেয়াদ ও কার্যপরিধি নিয়ে আলোচনা চলমান থাকবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল দিনব্যাপী এই সংলাপে অংশ নেয়।
সংলাপ শেষে বিকেলে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে, সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আসন নির্ধারণ করা হবে।"
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতি আদমশুমারি বা অনধিক ১০ বছর পর সংসদীয় আসন নির্ধারণে সংবিধানের ১১৯(১)(গ) অনুচ্ছেদের শেষে 'এবং' শব্দটির পর 'আইনের দ্বারা নির্ধারিত একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিধান' যুক্ত করা হবে। ২০২১ সালের 'জাতীয় সংসদের আসন পুনঃনির্ধারণ আইন', যা ২০২৫ সালে সংশোধিত হয়েছে, তার ৮(৩) ধারা অনুযায়ী কমিটির কাঠামো ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, "সকল রাজনৈতিক দলই এ বিষয়ে একমত। আজকের আলোচনায় গঠন, কাঠামো ও এখতিয়ার নিয়েও মতবিনিময় হয়েছে। দলগুলো একে অপরের আরও কাছাকাছি এসেছে।"
আমরাই চূড়ান্ত সহযোগিতা করছি – বিএনপির সালাউদ্দিন আহমেদ
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, "আমরাই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছি। কিন্তু আমাদের যেন এই তকমা না দেওয়া হয় যে আমাদের কারণে ঐক্যমত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা চূড়ান্তভাবে সহযোগিতা করেছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা ৬টি সংস্কার কমিশনে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। কেবল দুদক সংস্কার কমিশনের একটি প্রস্তাবে মত দিইনি, যা ছিল আইনগত বিষয়। সামাজিক আন্দোলন ও গণমাধ্যমে আলোচনা দেখে মনে হয়েছে এসব বিষয় বলা দরকার।"
তিনি উল্লেখ করেন, "৩ জুলাইয়ের আলোচনার পর অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা নিজেরাই প্রস্তাব দিয়েছি। একটি ব্যালান্সড সরকার নিশ্চিত করতেই আমাদের এই মতামত।"
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে সালাউদ্দিন বলেন, "আমরা বলেছি চিফ জাস্টিস নিয়োগে আপিল বিভাগের বিচারকদের নিয়েই সিদ্ধান্ত হোক। একটি দল ছাড়া সবাই একমত হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, "সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩৪টি প্রস্তাবনার বিষয়ে আমরা বিস্তারিত মত দিয়েছি এবং অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি। ন্যায়পাল গঠনের বিষয়েও বলেছি, এটি যেন কার্যকর ও শক্তিশালী হয়।"
সীমানা নির্ধারণ নিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই প্রস্তাবটি আমি দিয়েছিলাম। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের সাবসেকশন ১-এ ডেলিমিটেশন নিয়ে বলা আছে। আমরা বলেছি আদমশুমারির পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমানা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হোক। সবাই এতে একমত হয়েছে।"
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বিষয়ে তিনি বলেন, "৯০ দিনের মেয়াদই থাকুক, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে ৩০ দিন বাড়ানোর সুযোগ রাখা যেতে পারে। শুধু বিচার বিভাগকে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়, এটি নিয়ে অধিকাংশ দলই একমত।"
তিনি বলেন, "কেয়ারটেকার গঠন নিয়ে জুডিশিয়ারিকে বাদ দিয়ে বিকল্প বিধান রাখার কথাও আমরা বলেছি। ১৫তম সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করলেই অগ্রগতি হবে।"
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এটা অবাস্তব প্রস্তাব। ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়াদ তো এক এক সময়ে শেষ হয়। সেক্ষেত্রে ৫ বছর ধরে কেয়ারটেকার রাখা সম্ভব নয়।"
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৪ মাস চায় জামায়াত
জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাবে আমরা একমত। বাংলাদেশে এই ধারণা প্রথম আমরা দিয়েছি। তবে গঠন ও মেয়াদ নিয়ে আলোচনা চলছে। কমিশনের প্রস্তাব ছিল ৩ মাস, আমরা বলেছি ৪ মাস। আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চাই।"
তিনি আরও বলেন, "প্রেসিডেন্টকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর বিষয়ে দলগুলো দ্বিমত জানিয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে নিয়েও আলোচনা চলছে। এখানে বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।"
নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মন্তব্য প্রসঙ্গে তাহের বলেন, "আমরা মনে করি এটাই সবচেয়ে উপযোগী এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে।"
তিনি বলেন, "সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সেই কমিটি নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা ও সুপারিশ করবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইসির অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে, যেটি সময় স্বল্পতার কারণে এবার সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "এই কমিটি স্বাধীন হবে, বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গঠিত হবে। এর নাম হবে 'কমিটি', 'কমিশন' নয়—এ নিয়ে সবার ঐকমত্য হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, "সংবিধানে এই কমিটির বিষয়টি যুক্ত করার বিষয়ে বিএনপি সম্মতি দিয়েছে। আমরাও সমঝোতায় গিয়েছি। কমিশনের জায়গায় 'কমিটি' মেনে নিয়েছি। প্রধান দুই দল একমত হওয়ায় বাকিরাও রাজি হয়েছে।"
প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে সব দলের কমিটি চায় এনসিপি
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, "আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচনী আসন নির্ধারণ কমিশনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে ঐকমত্যের স্বার্থে এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি সাংবিধানিক বিশেষায়িত কমিটি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবো।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সংসদের একটি অল পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করে বিভিন্ন দল থেকে ১১ জন সদস্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করা হবে—এমন প্রস্তাবে অনেক দল সম্মত হয়েছে এবং পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে।"
এদিকে, আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল ১১টা থেকে কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পরবর্তী দফার আলোচনা শুরু হয়েছে।