আস্থা কমছে বিমা খাতের ওপর, উচ্চ ঝুঁকিতে ৩২ কোম্পানি: নিয়ন্ত্রক সংস্থা

দেশে কার্যরত ৮২টি বিমা কোম্পানির মধ্যে ৩২টিই বর্তমানে 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এতে বিমা খাতের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বুধবার (২ জুলাই) রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম জানান, উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ১৫টি জীবন বিমা কোম্পানি এবং ১৭টি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠান।
তিনি জানান, দেশে বিদ্যমান ৩৬টি জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৬টি ভালো অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে ১৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাঝারি ঝুঁকির শ্রেণিতে।
আইডিআরএ'র একটি সূত্র জানিয়েছে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে রয়েছে—ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, সানলাইফ, গোল্ডেন লাইফ, বায়রা লাইফ, প্রগ্রেসিভ লাইফ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, বেস্ট লাইফ, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ, যমুনা লাইফ এবং স্বদেশ লাইফ। এসব কোম্পানির আর্থিক অবস্থান যাচাইয়ে বর্তমানে বিশেষ নিরীক্ষা (স্পেশাল অডিট) চলছে।
চেয়ারম্যান বলেন, "বিমা কোম্পানিগুলো সময়মতো গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করতে না পারায় খাতে আস্থা নষ্ট হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের বিমার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।"
তিনি আরও জানান, "জীবন বিমা খাতে ৪৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিমা খাতে প্রায় ৪৭ শতাংশ দাবি এখনো অপরিশোধিত রয়েছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা আইন ও বিধিমালার সংস্কার প্রস্তাব করেছি। ব্যাংক রেজল্যুশনের আদলে বিমা খাতের জন্যও 'রেজল্যুশন অধ্যাদেশ' প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে একীভূতকরণ, অবসায়ন ও অধিগ্রহণের পথ সুগম হয়।"
চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের জিডিপি অনুপাতে বিমার হার ছিল ০.৯৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ০.৪১ শতাংশে। ২০২৪ সালে তা আরও হ্রাস পেয়েছে।
তিনি জানান, ২০২৩ সালে আইডিআরএ মোট ২৪,৮৫২টি অভিযোগ পেয়েছে, যার বিপরীতে মাত্র ৩৮টি লিখিত জবাব পাওয়া গেছে। জনবল সংকটের কারণে এসব অভিযোগ যথাযথভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে আইডিআরএতে অনুমোদিত ১৬০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১০৭ জন।
নিবন্ধন নবায়ন ফি বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আইডিআরএ'র ব্যয় ও জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ফি বাড়ানো হয়েছে। ২০১২ সালে প্রতি হাজারে ৩.৫০ টাকা ফি নির্ধারিত ছিল, যা ২০১৮ সালে কমিয়ে ১ টাকা করা হয়। বর্তমানে তা ৫ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।"
সংস্থাটি জানায়, ২০২৩ সালে ভারতের বিমা খাতে গ্রস প্রিমিয়াম ছিল প্রায় ৬ লাখ কোটি রুপি, যেখানে বাংলাদেশের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮,২২৭ কোটি টাকা। ভারতের বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার বার্ষিক আয় যেখানে প্রায় ৬০০ কোটি রুপি, সেখানে ২০২৫–২৬ অর্থবছরে আইডিআরএর প্রস্তাবিত আয় ৩৭.৫৯ কোটি টাকা এবং ব্যয় ৩৭.৬৮ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ, উচ্চ পরিচালন ব্যয় এবং দাবির অর্থ পরিশোধে বিলম্বের কারণে সম্পদ সংকটে পড়েছে।
বিমা কোম্পানির সম্পদ গড়ে ওঠে মূলত প্রিমিয়াম ও বিনিয়োগ আয়ের ভিত্তিতে। এসব অর্থ সরকার ও বেসরকারি বন্ড, শেয়ার, বন্ধকী ঋণ এবং রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এছাড়া ক্যাশ ভ্যালু জমা ও লভ্যাংশ কোম্পানির মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করে।
তবে বর্তমানে অনেক কোম্পানি দাবির অর্থ পরিশোধে বাধ্য হয়ে স্থায়ী আমানত ভেঙে ফেলছে। ফলে সুদ আয় কমে যাচ্ছে এবং মূলধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত এজেন্ট কমিশন, উচ্চ প্রশাসনিক ব্যয় এবং বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা সম্পদ ক্ষয়ের কারণ হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, বিমা খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ কৌশল গ্রহণ, খরচে নিয়ন্ত্রণ এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে দাবির অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইডিআরএ আশঙ্কা করছে, ভবিষ্যতে অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ, জনবলসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ৪ গুণ বা তারচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় 'বীমা ব্যবসা নিবন্ধন ফি বিধিমালা, ২০১২' সংশোধনের জন্য একটি খসড়া প্রজ্ঞাপন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে এ বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।