আজিজু রিসাইক্লিং: ই-বর্জ্যকে অর্থনৈতিক মূল্যে রূপান্তর করছে যে প্রতিষ্ঠান

বেশিরভাগ মানুষ যেখানে আবর্জনার স্তূপ দেখেন, সেখানেই সম্ভাবনা খুঁজে পান কেউ কেউ। আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। দেশে বাড়তে থাকা ইলেকট্রনিক বর্জ্যের (ই-বর্জ্য) মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দেখছে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা—পরিত্যক্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশকে রূপান্তর করছে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহারযোগ্য কাঁচামালে।
নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে একটি আধুনিক ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা স্থাপন করেছে আজিজু রিসাইক্লিং। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ই-বর্জ্যের খুব সামান্য অংশই আনুষ্ঠানিকভাবে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইকেল করা হয়, অথচ এই খাতে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সম্ভাবনা রয়েছে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক রিসাইক্লার টিইএস-এএমএম এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত আজিজু রিসাইক্লিং ই-বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে কাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সেবার মধ্যে রয়েছে—ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং, অন-সাইট ডিসপোজাল, শিল্প বর্জ্যের পুনঃব্যবহার, হার্ডডিস্ক ও সলিড স্টেট ড্রাইভ ডিগাউসিং এবং হার্ড ড্রাইভ শ্রেডিং।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আজিজু রিসাইক্লিং বর্তমানে বছরে ৭ হাজার টন ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রাখলেও মানসম্পন্ন বর্জ্য না পাওয়ায় মাত্র ৩০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে বলে জানান কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হোসেন আল-মামুন।
কারখানা পরিদর্শনে দেখা গেল, সেখানে মনিটর, প্রিন্টারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ থেকে ধাতব উপাদান আলাদা করে গলিয়ে ইনগট আকারে রূপান্তর করা হয়, যা ফিনিশড পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় বাজারে।

এই বর্জ্য সংগ্রহ শুধু স্থানীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি–সহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও সরবরাহকারীর কাছ থেকেও হয়ে থাকে। রিসাইক্লিংকৃত উপকরণ পরে ওয়ালটন, কিয়াম, পলি ক্যাবলস, রি-রোলিং মিলস ও বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানায় সরবরাহ করা হয়।
হোসাইন আল-মামুন বলেন, "বাংলাদেশে কয়েকটি রিসাইক্লিং কারখানা থাকলেও তারা সম্পূর্ণ রিসাইক্লিং করে না। আমরা তাদের কাছ থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেরাই ফিনিশড পণ্য তৈরি করি এবং তা স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করি।"
তিনি জানান, কিছু কাঁচামাল একপর্যায়ে প্রক্রিয়াজাত করে সিঙ্গাপুরেও পাঠানো হয়, যেখানে তা সম্পূর্ণ ফিনিশড পণ্যে রূপান্তরিত হয়।
তার ভাষায়, "আমরা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করি। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, মানসম্পন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নির্ধারিত মান বজায় রাখা হলেও স্থানীয় সংগ্রাহকেরা তা মানেন না। ফলে অনেক সময় তা ব্যবহারযোগ্য থাকে না।"
তিনি বলেন, "স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ বাড়লেও পরিবেশবান্ধব কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন সরবরাহ এখনো অপ্রতুল। তাই আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ আমাদের তৈরি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই এখনো আমদানি করা হয়, যেখানে দেশীয় চাহিদা অনেক বেশি।"
বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-বর্জ্যকে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারলে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আন্তর্জাতিক ই-বর্জ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ যদি দেশের সব বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারে, তাহলে ফেলে দেওয়া বা অনানুষ্ঠানিকভাবে রিসাইক্লিং হওয়া ই-বর্জ্য থেকেই বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে এরজন্য পরিবেশসম্মত ও নীতিমালা অনুযায়ী রিসাইক্লিং নিশ্চিত করা জরুরি।

ওয়েস্ট ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট (ডব্লিউইইই) সোসাইটি বাংলাদেশ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে দেশে উৎপন্ন ৩৬৭ মিলিয়ন কেজি ই-বর্জ্যের মাত্র ০.৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও প্রতি বছর গড়ে ৩.৪ শতাংশ হারে এই বর্জ্য বাড়ছে।
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে ডব্লিউইইই সোসাইটি-বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আক্তার উল আলম বলেন, "প্রতিকেজি ই-বর্জ্য থেকে ১ ডলারের বেশি মূল্যের কাঁচামাল পাওয়া সম্ভব। এর ৮০–৯০ শতাংশ খরচ হয় সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণে। প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়বহুল হলেও অব্যবস্থাপনার কারণে এর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আরও বেশি।"
তিনি আরও জানান, বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ নীতিমালা, প্রণোদনা ও বিনিয়োগ থাকলে এ খাত থেকে বছরে ৪০–৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মুনাফা আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী ২০২৪ সালের ওই অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে প্রতিবছর টেলিকম খাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ৩ হাজার টন ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং করা হয়। অন্যান্য সব ধরনের ই-বর্জ্য নিয়েও দেশব্যাপী সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, আজিজু রিসাইক্লিংসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিক রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করছে যে, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক।
বাংলাদেশের ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং খাতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ উপায়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিংয়ে কাজ করছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এরমধ্যে অন্যতম হলো জেআর এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে।

এরপরে রয়েছে এম/এস জামান এম/এস জামান এন্টারপ্রাইজ। ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুনঃব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেড করপোরেট পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ রিসাইক্লিং নিশ্চিতে কাজ করছে।
এছাড়া, ইউসুফ এন্টারপ্রাইজ স্থানীয়ভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ভূমিকা রাখছে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা বাড়ানোসহ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।