নিরাপত্তাহীনতায় মৌয়ালরা, কমেছে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ

দেশে বাজারে মধুর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভেষজ গুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং স্বাদে বৈচিত্র্যের কারণে সুন্দরবনের মধু সবসময়ই ক্রেতাদের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে—এই বছর সুন্দরবন থেকে আহরিত মধুর পরিমাণ রয়েছে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে মধু আহরণ কমে যাওয়ায় বাজারে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে দাম, এবং ভেজাল মিশ্রণের প্রবণতাও বাড়ছে।
বছরে মাত্র দুই মাস সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের অনুমতি দেওয়া হয় মৌয়ালদের। প্রতিবছরের এপ্রিল ও মে মাসে বন বিভাগের রাজস্ব পরিশোধ করে মৌয়ালরা মধু আহরণ করেন।
বন বিভাগের তথ্য মতে, এই বছর বন থেকে মৌয়ালরা ২ হাজার ৭৬ কুইন্টাল মধু আহরণ করেছেন। তবে পাঁচ বছর আগে ২০২১ সালের মধু আহরণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল, ২০২২ সালে ছিল ৩ হাজার ৮ কুইন্টাল, ২০২৩ সালে ছিল ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল ও ২০২৪ সালে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল।
মৌয়ালরা এ বছর বনে কম গেছেন বিধায় গত ৫ বছরের মধ্যে এ বছর মধু কম সংগৃহীত হয়েছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা কালাবগির আসাদুল বলেন, এখন বনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারেই দুর্বল। কোস্ট গার্ডের টহল কম, আর বন প্রহরীদের ডাকাত মোকাবেলার সক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর বনে গিয়ে মধু সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের মধু টিকিয়ে রাখতে হলে মৌয়ালদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
মধু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সুন্দরবনের মধু দেশের বাজারে সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের একটি। কারণ এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, এতে কোনো রাসায়নিকের মিশ্রণ থাকে না। বনের বন্যপ্রাণ ও উদ্ভিদ নির্ভর প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্ম নেওয়া ফুল থেকেই মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে। আর এই খাঁটি বৈশিষ্ট্যের কারণেই সুন্দরবনের মধু নিয়ে রয়েছে ক্রেতাদের বাড়তি আগ্রহ।
তবে তারা জানান, এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম বা খামারে পালিত মৌমাছির মাধ্যমে উৎপাদিত মধু সুন্দরবনের খাঁটি মধু বলে বাজারে বিক্রি করছেন। এতে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা, আবার বাজারে খাঁটি মধুর স্বতন্ত্রতাও নষ্ট হচ্ছে।
সুন্দরবনের মধু ব্যবসার সঙ্গে ১৩ বছর ধরে যুক্ত সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, খামারে বাক্স পদ্ধতিতে যেসব মৌমাছি পালন করা হয়, সেগুলো সাধারণত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় এমন ফসলের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। ফলে সেই মধুতে রাসায়নিক থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে, সুন্দরবনের গাছপালায় কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। সেখানকার ফুলগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, তাই সুন্দরবনের মধু খাঁটি ও নিরাপদ। এ কারণে বাজারে এর দামও বেশি এবং চাহিদাও অনেক।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বাজারে 'সুন্দরবনের খাঁটি মধু' লেখা লেবেলযুক্ত নানা ব্র্যান্ড থাকলেও অধিকাংশই সন্দেহজনক। কারণ, সুন্দরবন থেকে আহরিত প্রকৃত মধুর পরিমাণ অনেক কম হলেও বাজারে এই নামে বিক্রি হচ্ছে হাজার হাজার বোতল।
খুলনার মধু ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবনের মধু 'জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই)' বা ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে এমন একটি সময়ে যখন বিশ্ববাজারে সুন্দরবনের মধুর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, তখনই দেশের ভেতরে মধু আহরণ কমে যাওয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জিআই ট্যাগের সম্ভাবনাও বাস্তবায়িত হবে না।
তবে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, মৌয়ালদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আসল আর নকল মধু চট করে শনাক্ত করা খুবই কঠিন। আমাদের অভিযান পরিচালনার সময় আমরা সাধারণত বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগারের সহায়তা নিই। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে—যাচাই-বাছাই করেই মধু কিনতে হবে, শুধু 'সুন্দরবনের খাঁটি মধু' লেখা লেবেল দেখে নয়।