বর্ষা শুরুর আগেই বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক

সামনের ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবেলা করতে যখন বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা জেলায় আগেভাগেই নজিরবিহীন সংকট দেখা দিয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত সারাদেশের মধ্যে বরগুনাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের হার সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্যমতে, দেশের মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার প্রায় ২৮ শতাংশই বরগুনার। এ বছর ডেঙ্গুতে সারাদেশে ২৯ জনের মৃত্যু হলেও বরগুনায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের—এর মধ্যে ১২ জুন একদিনেই প্রাণ গেছে ৪ জনের।
এই পরিস্থিতি সময়ের বিচারে আরও উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালের ১৪ জুন পর্যন্ত বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মাত্র ৩২ জন এবং কোনো মৃত্যুর খবর ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালে একই সময়ে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৪ জনে, আর নিশ্চিতভাবে একজনের মৃত্যুর তথ্য মিলেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও সংক্রমণ রেকর্ড হয়েছে। তবে বরগুনায় শুরুতেই ব্যাপক হারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে ২০২৫ সালের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা ড. কবিরুল বাশার বলেন, বরগুনায় যে ডেঙ্গু সংকট তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো সম্ভব ছিল।
তিনি বলেন, 'আমরা আগেই—গত বছরই—সতর্ক করেছিলাম যে বরগুনা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার বা স্বাস্থ্য বিভাগ কেউই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি।'
তিনি আরও জানান, বরগুনায় এডিস মশার প্রজননস্থল অত্যন্ত ঘন। বিশেষ করে মাটির কলস ও ড্রামে পানি জমিয়ে রাখার কারণে বাসাবাড়িতেই এই মশার বিস্তার ঘটছে। 'এখানে ৫০ শতাংশের বেশি পানি রাখার পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে। এটি কেবল শুরু—আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।'
ড. বাশার বলেন, 'শুধু কীটনাশক ছিটালেই হবে না। সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিতে হবে, প্রজননস্থল শনাক্ত করতে হবে, এবং লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে।'
অতিরিক্ত ভিড় ও সীমিত সম্পদ
মাত্র ৫০টি ডেঙ্গু রোগীর জন্য নির্ধারিত বেড থাকা বরগুনা সদর হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ২১৯ জন রোগী। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরা অত্যধিক চাপের মধ্যে আছেন। করিডোর থেকে শুরু করে ফাঁকা জায়গায় রোগীদের রাখা হচ্ছে।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. তাজকিয়া সিদ্দিকা বলেন, 'মৌসুমের এতো শুরুর দিকে এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা আগে কখনো দেখিনি। এমনকি জরুরি বিভাগও ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীতে পরিপূর্ণ। অনেক বাড়িতে প্রায় প্রতিটি সদস্যই আক্রান্ত।'
তিনি জানান, পানি জমে থাকা ও অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। 'প্রায় প্রতিটি বাড়ির আশপাশে পানি জমে আছে, ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চারপাশে নদী থাকলেও এখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল।'
চাপ সামাল দিতে অতিরিক্ত ৬ জন চিকিৎসক ও ১০ জন নার্সকে দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে ডা. তাজকিয়া জানান, প্রয়োজনীয় জনবলের অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না এতে।
হালকা উপসর্গ দেখা দিলে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক পরিবার হাসপাতালে এসে ভর্তি হতে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে বা তাদের বাড়িতেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
পুরুষরা বেশি ঝুঁকিতে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) দৈনিক বুলেটিন অনুযায়ী, গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নতুন করে ১৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং চট্টগ্রামে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ১০১ জনই বরিশাল বিভাগের (বরিশাল সিটি করপোরেশন বাদে)। এর মধ্যে ৫৪ জনই বরগুনা জেলার।
জাতীয়ভাবে, ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৩৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বরিশাল বিভাগে – ২ হাজার ৫৮৯ জন। তবে মৃত্যুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকাই শীর্ষে, যেখানে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে পুরুষরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ বছর এখন পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু হলেও, এর মধ্যে ১৯ জনই পুরুষ। মৃতদের মধ্যে ৯ জনের বয়স ছিল ৩৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, আর ১০ জনের বয়স ছিল ৫০ বছরের বেশি।