তালাবদ্ধ নগর ভবন; ওয়াসা ভবনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সভা, ডেঙ্গু প্রতিরোধে দ্বিগুণহারে কীটনাশক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত

ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে কীটনাশক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
বুধবার (১১ জুন) রাজধানীর ওয়াসা ভবনে ডিএসসিসি'র প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার বিস্তার রোধে করণীয় নির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও করোনা প্রতিরোধে একটি জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ পড়ানোর দাবিতে ইশরাক সমর্থক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির কর্মচারীদের একটি অংশ গত ১৫ মে থেকে প্রায় একমাস ধরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন।
ঈদুল আযহার কারণে ঈদের আগে থেকে আন্দোলন শিথিল করলেও নগর ভবনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন ইশরাক হোসেন। তাই ডিএসসিসি'র কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ওয়াসা ভবনে সভা আয়োজন করেন ডিএসসিসি'র প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া।
যদিও প্রশাসক একইসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছেন।
সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান, কর্পোরেশন সচিব মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. মাহাবুবুর রহমান তালুকদার, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সোমবারও (৯ জুন) দক্ষিণ সিটির কোরবানির বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পর্কিত পর্যালোচনা নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করেন দক্ষিণের প্রশাসক।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে ডিএসসিসি'র একাধিক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'যেভাবে নগর ভবনে তালা দিয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে এমনটা চলতে থাকলে নগরবাসীর ভোগান্তি সামনে আরও বাড়বে। নগর ভবনে প্রবেশ করতে না পেরে প্রশাসক ওয়াসা ভবনে কিংবা সচিবালয়ে জরুরী মিটিংগুলো সম্পাদন করছেন।'
ডিএসসিসি'র প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'আমি যেহেতু ওয়াসার এমডি সেহেতু ওয়াসা ভবনেই বসি। নগর ভবন তালাবদ্ধ থাকায় আমাদের কারো পক্ষে সেখানে গিয়ে অফিস করা তো সম্ভব নয়। যেহেতু এখন সংকট চলছে তাই বিকল্প ব্যবস্থায় জরুরি কাজ চালিয়ে নিতে এখানে মিটিং করতে হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আন্দোলনকারীরা কোরবানীর ঈদ উপলক্ষে তাদের আন্দোলন শিথিল করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, যান্ত্রীক বিভাগসহ তিনটি বিভাগ খুলে দিয়েছিল। ফলে কোরবানীর সময়ে; বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পুরোদমে করা সম্ভব হয়েছিল।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু এখন যদি আবার অফিসগুলো বন্ধ করে দেয় তবে আগামীতে জলাবদ্ধতা, মশক নিধনেও ইমপ্যাক্ট পড়বে। অন্যান্য নাগরিক সেবা অধিকাংশই তো বন্ধ রয়েছে। যতোদিন এ সংকট চলবে ততদিন বিকল্প উপায়ে সমন্বয় করার চেষ্টা করব।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসি'র রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ বন্ধ থাকা মানে সকল আয় বন্ধ। আমরা কোনো হোল্ডিং ট্যাক্স, লাইসেন্স নবায়ন কিংবা অর্থ আয়ের কাজ করতে পারছি না। এর প্রভাব সিটি কর্পোরেশনের বাজেটে গিয়ে পড়বে।'
এদিকে ঈদের আগে মঙ্গলবার (৩ জুন) আন্দোলন শিথিলের ঘোষণা দিয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, 'এই নগর ভবনে কোনো বহিরাগত প্রশাসক ও কোনো উপদেষ্টা প্রবেশ করতে পারবেন না। ঈদে নগরবাসীর সেবা নিশ্চিত করা ও জনগণের ভোগান্তি বিবেচনায় নিয়ে আপাতত কর্মসূচি শিথিল করা হয়েছে। সরকার এর মধ্যে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিলে জনগণই তাদের মেয়রকে শপথ পড়িয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে।'
সেসময় তিনি আরও বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে অবিলম্বে তার শপথ আয়োজনের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়েই শপথ আয়োজন করা হবে।'
নগর ভবনের মূল ফটকে ১৫ মে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। এতে কার্যত বন্ধ হয়ে আছে সিটি করপোরেশনের সব ধরনের দৈনন্দিন সেবা কার্যক্রম। বন্ধ হয়ে আছে হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স, জন্মনিবন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা। ঈদের বন্ধের শেষে আগামী সপ্তাহে অফিস খুললেও নগর ভবন আদৌ খুলবে কি-না এ নিয়ে আছে শঙ্কা।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনকে পৌনে দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস। তখন নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে মামলা করেন ইশরাক হোসেন।
৫ আগস্টের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পরে গত ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল সেই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে। এরপর ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ। শুনানি নিয়ে রিট সরাসরি খারিজ করে ২২ মে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের বিরুদ্ধে মেয়র ঘোষণা ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ২৬ মে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন রিট আবেদনকারী।
পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে দ্বিগুণ কীটনাশক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত
বুধবারে এডিস মশার বিস্তার রোধে জরুরি সভায় প্রতিদিন দ্বিগুণহারে কীটনাশক প্রয়োগ, অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং টিম গঠন ও জনবল ঘাটতি পূরণে উদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ডিএসসিসি।
সভায় এডিস মশার বিস্তার রোধকে বর্তমানে ডিএসসিসি'র সর্বোচ্চ গুরত্বপূর্ণ এজেন্ডা নির্ধারণ করে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সভায় এডিস মশার বিস্তার রোধে তাৎক্ষণিক ফলাফল লাভে আগামী ১৪ জুন থেকে ডিএসসিসি এলাকায় এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমে (ফগার মেশিন দ্বারা পরিচালিত) বর্তমানে ব্যবহৃত ৩০ লিটার কীটনাশকের পরিবর্তে দ্বিগুণ পরিমাণ, অর্থাৎ ৬০ লিটার কীটনাশক প্রতিদিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মশক কর্মীদের সকাল ও বিকালের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, সঠিক অনুপাতে কীটনাশক প্রয়োগ যাচাইকরণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং মশককর্মী দ্বারা বাড়ির ভিতর, আঙিনা ও ছাদের জমানো পানিসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং টিম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া, ডেঙ্গু ও করোনা বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফারিয়া ফয়েজ, মোবাইল নম্বর: ০১৮৪১২১১০৯৮- কে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসেবে মনোনীত করা হয়।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি মাসের মধ্যে কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে নগর ভবনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে এবং প্রতিদিনের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের হালনাগাদ তথ্য ডিএসসিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। মশক নিধনে জনবল ঘাটতি পূরণে নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাসহ ডেঙ্গু ও করোনা রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।