সাম্প্রতিক ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যছাড় কার্যক্রম ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে

বাংলাদেশের ব্যস্ততম বন্দরে আরও একবার সৃষ্টি হলো অচলাবস্থা – তবে এবার কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যয়ের কারণে নয়, বরং যাদের হাতে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব, সেই রাজস্ব কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণেই বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ২৪,০০০ আমদানি কনটেইনার বোঝাই ১৭টি জাহাজ জেটিতে নোঙর করার জন্য অপেক্ষা করছিল, আর বন্দরের অভ্যন্তরে মজুত রয়েছে ৪২,৩১৫ টিইইউ'স (টুয়েন্টি-ফুট ইক্যুইভেলেন্ট ইউনিট) কনটেইনার।
চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমসের কার্যক্রম টানা দ্বিতীয় দিনের মতো প্রায় বন্ধ থাকার পর অবশেষে গতকাল রাতেই তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে আমদানিকারকরা পড়েছেন জটিল প্রক্রিয়া ও জরিমানার চাপে। প্রতিদিনের বিলম্বের জন্য ৪০-ফুট কনটেইনার প্রতি পোর্ট ডিমারেজ ফি ৩৮ ডলার হিসেবে ধরা হচ্ছে। অষ্টম দিন থেকে এই ফি বেড়ে প্রায় ১৮০ ডলারে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে শিপিং লাইনের আরোপিত অতিরিক্ত জরিমানা—যা অষ্টম দিন থেকে প্রতিদিন ১৮০ ডলার এবং এরসাথে যোগ হচ্ছে ভ্যাট।
"একটা সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে আমরা শাস্তি পাচ্ছি, যে সিদ্ধান্ত আমরা নেইনি, এমনকি যেখানে আমাদের প্রভাব রাখারও ক্ষমতা নেই,"—হতাশা প্রকাশ করে বলেন এক আমদানিকারক।
আরেক আমদানিকারক জানান, "এটা কেবল একটি বিঘ্ন নয়, এটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা। দেশ যখন মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলও নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরে কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারের সংস্কার ও রূপান্তর ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তুলছে।"
সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভাঙার পরিকল্পনা প্রশাসনিকভাবে যৌক্তিক হতে পারে। কিন্তু স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এবং কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নীতি বাস্তবায়নে শূন্যতা তৈরি করেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি পণ্যের এসেসমেন্ট ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ডেলিভারি প্রায় অর্ধেক কমে যওয়ায় বন্দরে সৃষ্টি হয়েছে কন্টেইনার জট। বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি নিতে না পারায় গুদাম বাবদ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, "সাধারণ দিনে বন্দরে ১,২০০ থেকে ২,৫০০ কনসাইনমেন্ট পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সেদিনই ছাড় হয়ে যায়। কিন্তু এখন ছাড়প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।"
এই অচলাবস্থার প্রভাব বন্দর ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন লাইন বন্ধ হওয়ার পথে। সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যস্ত। রপ্তানি সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ঈদ সামনে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, নতুন করে পণ্যের সংকট ও মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে।
"মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে," সতর্ক করেন আরেক ব্যবসায়ী। "আমরা বাধ্য হয়েই এই অতিরিক্ত খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেব।"
বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনার জট
গত ১১ মে বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেইনার ছিল ৩৬৮০৯ টিইইউ। ২০ মে এই সংখ্যা ৭৪২২ টিইইউ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪২৩১ টিইইউ হয়।
১৯ মে বিকাল ৩টা থেকে কর্মসূচি স্থগিত হওয়ার পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল কন্টেইনার ডেলিভারি পরিস্থিতি। ২৪ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরে কন্টেইনার ছিল ৪১,৩১৪ টিইইউ, যা কমে নেমে আসে ২,৯১৭ টিইইউতে।
তবে ২৪ মে থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির কারণে আবারও বাড়তে শুরু করেছে কন্টেইনার সংখ্যা। ২৫ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২,৩১৫ টিইইউতে।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৪ হাজার আমদানি পণ্যবাহী ১৭টি জাহাজ বন্দর ইয়ার্ডে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৫৩,৫১৮ টিইইউ, যেখানে বর্তমানে আছে ৪২,৩১৫ টিইইউ কন্টেইনার। কন্টেইনার ডেলিভারি যথাসময়ে না হলে নতুন কন্টেইনার নামানো নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি এবং সিসিটির টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত রমজানের ঈদের লম্বা ছুটির প্রভাব এবং প্রাইম মুভার চালকদের একাধিক ধর্মঘটের প্রভাব এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এর মধ্যে এনবিআর কর্মকর্তাদের টানা কর্মবিরতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। ঈদুল আজহার ছুটিতে বহির্নোঙরে জাহাজের সংখ্যা বাড়বে, ফলে বন্দরে ভয়াবহ জটের আশঙ্কা আছে।"
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পার্সোনেল অফিসার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, "যতটুকু পণ্য খালাস হওয়ার কথা, কাস্টমসের কর্মবিরতির কারণে তা হয়নি। তাই প্রতিদিনই জট বাড়ছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা আছে।"
চট্টগ্রাম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানান, "আমরা তিন-চার দিন আগের আমদানি ফাইলও দাখিল করতে পারছি না। সিএন্ডএফ এজেন্টরা এক অফিস থেকে অন্য অফিসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা কোনো কাগজপত্র গ্রহণ করছেন না।"
এদিকে, বেনাপোল বন্দরে পণ্যের জট তৈরি হয়েছে। বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫১,০০০ মেট্রিক টন হলেও, স্বল্প হারে পণ্য ছাড়ের কারণে সেখানে বর্তমানে ৭০,০০০ মেট্রিক টনের বেশি পণ্য জমা হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ১৪ মে থেকে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি শুরু হলেও ২০ এবং ২২ মে সাময়িকভাবে কিছু পণ্য ছাড়ের কাজ হয়েছিল।