গুলশান লেক দখল করে চলছে অবৈধ পার্কিং ব্যবসা

রাজধানীর গুলশানের মসজিদে গাউসুল আজম এলাকার পাশে গুলশান লেকের একটি অংশ দখল করে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং ব্যবসা চালানো হচ্ছে। প্রভাবশালী একটি চক্র ইট, বালু ও মাটি ফেলে ধীরে ধীরে লেক দখল করছে।
জানা গেছে, ওই জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ভাড়া দিয়ে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা আয় করছে চক্রটি।
গত সপ্তাহে লেকের নতুন একটি অংশ ভরাটের মাধ্যমে দখল প্রক্রিয়া আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হলে, পরিবেশ অধিদপ্তর তাতে হস্তক্ষেপ করে। পরে বন্ধ হয় ভরাট কার্যক্রম।
এ ঘটনায় দায়ী কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করে, আর লেক ভরাট করবে না বলে অঙ্গীকার করেছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তথ্য অনুযায়ী, কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স ২০০৯ সাল থেকে, অর্থাৎ গত ১৫ বছর ধরে গুলশান লেকের একটি বড় অংশ ভরাট করে আসছে। সম্প্রতি আবার ভরাটের চেষ্টা করায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে এবং দখল ঠেকাতে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
তবে কাদেরিয়া পাবলিকেশন্সের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, নতুন করে কোনো ভরাট কাজ তারা করেননি। রাজউকের সঙ্গে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে এবং বর্তমানে এলাকায় সব ধরনের কাজ বন্ধ রয়েছে।
অবৈধ পার্কিং ব্যবসা
স্থানীয় সূত্র ও বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স লেকের জায়গা দখল করে সেখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৫০টি গাড়ি রাখা হয়। বড় যানবাহন যেমন বাস ও ট্রাকের জন্য মাসিক ভাড়া ৮,৫০০ টাকা এবং প্রাইভেটকারের জন্য ৫,৫০০ টাকা নেওয়া হয়।
এই জায়গার একজন প্রহরী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি এখানে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছি। প্রতি বছরই একটু একটু করে মাটি ফেলে জায়গা বড় করা হয়। আগে যেখানে ১৫-২০টি গাড়ি রাখা হতো, এখন নিয়মিত প্রায় ৫০টি গাড়ি রাখা হচ্ছে।"

সাম্প্রতিক অবস্থা
বৃহস্পতিবার (৮ মে) গুলশান লেকের মসজিদে গাউসুল আজম সংলগ্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স তাদের বাউন্ডারি দেওয়ালের বাইরের লেকের একটি বড় অংশ ভরাট করে সেখানে অবৈধভাবে পার্কিংয়ের জন্য ভাড়া দিচ্ছে।
নতুন করে বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের পাশে লেক ভরাট করে সেখানে মাটি ফেলা হয়েছে। আগেই ভরাট করা অংশের সঙ্গে আবারও ইট, বালু, সুরকি ফেলে লেকের ভেতরে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
যদিও এই অংশ ২০২২ সালে গেজেট হওয়া রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) লেকের জলাধার হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে।
গুগল আর্থের পুরোনো ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মসজিদ কমপ্লেক্সের সীমানার বাইরে লেক ভরাট করা হয়নি। তবে ২০০৯ সাল থেকে ধাপে ধাপে মাটি ফেলে ভরাট কার্যক্রম শুরু হয়, যা ২০১০ সালে আরও বাড়ে। ২০১১ সালের ছবিতে দেখা যায়, প্রায় ১২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০ মিটার প্রস্থের একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে।
২০১১ সালের পর থেকে একে একে আরও অংশ ভরাট করে জায়গা দখল করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রধান সড়কের পাশের অংশ টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখে অনেক আগে থেকেই দখল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রায় ১.৩ একর জলাভূমি মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে।
এই এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা লিয়াকত আলী টিবিএসকে বলেন, "এই এলাকায় আছি প্রায় ২৫ বছর। চোখের সামনে দেখছি লেক কীভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ এমনভাবে দেওয়াল ও টিনের প্রাচীর দিয়েছে যে রাস্তা কিংবা বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না ভিতরে কী হচ্ছে। নৌকায় চড়ে বস্তির দিকে গেলে বোঝা যায় ভিতরে কীভাবে ভরাট করা হচ্ছে।"
তবে কাদেরিয়া পাবলিকেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস লিমিটেড লেক ভরাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, তারা নিজেদের জমিতেই মাটি ফেলছে এবং পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও নিজেদের জমিতেই করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার মো. রবিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "এখন যেটাকে গুলশান লেক বলা হচ্ছে, আগে সেখানে ধান চাষ হতো। সেই জায়গা অনেক আগে থেকেই আমাদের জমি। আমরা আমাদের জমিতেই মাটি ফেলেছি, নতুন করে লেকের মধ্যে কোনো মাটি ফেলা হয়নি। রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের বিষয়টি মীমাংসিত।"
রাজউকের বাস্তবায়ন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "তাদের লেক ভরাটের বিষয়টি জানার পর পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের কাজে বাধা দেয়। একইসঙ্গে রাজউকের কাছেও মুচলেকা দিয়ে দরখাস্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যে তারা মুচলেকা না দিলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। তারা কোনোভাবেই জলাধার ভরাট করতে পারে না।"
তিনি আরও বলেন, "এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তাদের নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু তারা মানেনি। জলাধার আইন অনুযায়ী, নিজের জমিতেও যদি জলাধার থাকে, সেটাও ভরাট করা যাবে না। তারা গত ১৫ বছর ধরে ধীরে ধীরে লেক ভরাট করছে। এবার আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।"
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের মে মাসে গুলশান লেক ভরাটের অভিযোগে কাদেরিয়া পাবলিকেশন্সের মালিক এ এম এম বাহাউদ্দিনকে হাইকোর্ট তলব করে এবং লেক ভরাটে এক মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
গত ২১ অক্টোবরও গুলশান-মহাখালী সংযোগ সড়কের কালভার্টের পাশে গুলশান লেকের আরেকটি অংশ ভরাট কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।