সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুলের ওপর শুনানি মুলতবি

অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব— রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে জারি রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন হাইকোর্ট।
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এদিন রিটকারী পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইনজীবী শিশির মনির। পরে এ বিষয়ে আরো শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন আদালত।
শুনানি শেষে অ্যডভোকেট শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, "আমি শুনানিতে আদালতে বলেছি, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর রুলস অব বিজনেসের অধীনে স্থানান্তর করেছেন। স্থানান্তর করার কারণে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলী, পদোন্নতি, এবং শৃঙ্খলাবিধি— সবকিছুই আইন মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে সরানো যাচ্ছে না। এটি একটি দ্বৈত শাসন চলছে। একদিকে হলো প্রধান বিচারপতির শাসন, আরেকদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের শাসন। এই দ্বৈত শাসন থেকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের মুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম শাসনের অধীন প্রধান বিচারপতির অধীনে একটি স্বাধীন ও সেপারেট সচিবালয় প্রয়োজন।"
তিনি বলেন, "বিগত শাসনামলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যা 'ওয়ানটাইম ইউজে'র মতো। অর্থাৎ যখন যাকে যেভাবে ব্যবহারের সুযোগ হয়েছে, দরকার হয়েছে, সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো ছলেবলে কৌশলে, আবার কখনো বাধ্য করা হয়েছে। এমনও ঘটনা আমরা দেখেছি, একজন সাক্ষী তার সাক্ষ্য দিতে আদালতে এসেছেন, বিচারক এজলাস থেকে নেমে তাকে রিসিপশন ও বিদায়ী সম্বর্ধনা দিয়েছেন। এই একজন সাক্ষীকে বিচারক প্রটোকল দিয়েছেন, এসব কিছু হলো আইন মন্ত্রণালয়ের বাস্তব রূপ।"
তিনি বলেন, "শুধু তাই নয়, অধস্তন আদালতের কোনো বিচারকের বিষয়ে কোনো অভিযোগ – তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করতো। কাউকে যদি শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত থাকতো— তাহলে কিছু লোক দিয়ে কমিটি গঠন হতো, আর কাউকে যদি মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত থাকতো – তাহলে বিশেষ কিছু লোক দিয়ে কমিটি গঠন করতো।"
শিশির মনির বলেন, "আদালতে এটিও বলেছি, আইন মন্ত্রণালয় রাতের আঁধারে আদালত বসিয়েছে। নির্বাচনের আগে সারা দেশ থেকে নিজেদের পছন্দমতো বিচারকদের বদল করে ঢাকা আনা হয়— যাতে করে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে মামলায় দ্রুত সাজা দিয়ে নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। একটি মামলায় একদিনে ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করার কাজ করেছেন।"
তিনি বলেন, "হাইকোর্টের সামনে এটি ক্লিয়ার, একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা থেকে — একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনোই মোক্ষম সময়। যদি সেটি এখনই করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখনেই ঘটানোর খুব গুরুত্ব রয়েছে। অন্যথায় তাদের যদি স্বাধীনতা না দেয়া যায়, বিচারিক কোয়ালিটি কখনো উন্নতি করা সম্ভব নয়।"
অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকা সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে জারি রুলের ওপর হাইকোর্টে গত ২৩ এপিল চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়।
এর আগে গত ২০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এর বেঞ্চ বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদন নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ গঠন করে দেন।
মামলাটি বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি ও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। তবে গত ২৪ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় সেই বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এরপর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য নতুন বেঞ্চ নির্ধারণের আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
শিশির মনির গত বছরের ২৫ আগস্ট ১০ জন আইনজীবীর পক্ষে মূল সংবিধানের ১৯৭২ সালের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিটটি দায়ের করেন। পরে হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চায়—বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না।
বর্তমানে প্রযোজ্য (সংশোধিত) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে।' কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, 'বিচারকার্য বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বে নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।'
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলাবিধির ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব রয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।