৬৫ দিনের আন্দোলন আর ৫৮ ঘণ্টা অনশনের পর বিজয় কুয়েট শিক্ষার্থীদের

দীর্ঘ ৬৫ দিনের আন্দোলন আর ৫৮ ঘণ্টার অনশনে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল, তখনই খবর এল শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে (ভিসি) অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার।
বুধবার দিবাগত রাতে আসা সেই সংবাদে কুয়েটজুড়ে উঠেছিল আনন্দের বন্যা।
অনশনে বসা শিক্ষার্থী সিভিল বিভাগের রাহাতুল ইসলাম বলেন, 'রাত সোয়া ১টার দিকে ক্যাম্পাসে এসে তানজিম স্যার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি পত্র আমাদের পড়ে শোনান। তাতে জানতে পারি ক্যাম্পাসের স্বৈরাচারী ভিসিকে সরকারের পক্ষ থেকে অপসারণ করা হচ্ছে। তখন থেকে ক্যাম্পাসে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। '
তিনি বলেন, 'সারা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে ছিলেন বলে আমাদের এই বিজয় এসেছে। প্রত্যেকের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা।'
১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদল ও বহিরাগত বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। তাতে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হন। তখন থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা ও ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় মদত দেওয়ার অভিযোগে এনে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
বুধবার রাতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মামুন অর রশিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অনতিবিলম্বে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ দুটি পদে নতুন নিয়োগ প্রদান করা হবে। অন্তর্বর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে একজনকে সাময়িকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।
এর আগে বুধবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সি আর আবরার। তখন তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা তার অনুরোধ প্রত্যাখান করে হলের পানি ও ইন্টারনেট বন্ধের কথা উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। একইসঙ্গে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ব্যাপারে অভিযোগ করেন।
উপদেষ্টা সেই সময়ে শিক্ষার্থীদের বলেন, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দুইজন সদস্য এসেছেন। তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে কুয়েট প্রশাসনকে অবহিত করবেন এবং শিক্ষার্থীদের যাবতীয় অসুবিধা দ্রুত সমাধান করা হবে।
উপদেষ্টা সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের সঙ্গে কোনো সভা করেননি। এমনকি তাকে কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এরপর ইউজিসির সদস্যদের সঙ্গে কুয়েট প্রশাসনের সভা হয়। পরে সাড়ে ১২টার দিকে জরুরি সিন্ডিকেট বসিয়ে ৩৭ শিক্ষার্থীর সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং ৭টি হল প্রশাসনিকভাবে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপদেষ্টা সি আর আবরার বলেন, 'তোমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতি শীঘ্রই তারা তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর তোমাদের দাবির বিষয়ে আমরা যথারীতি ব্যবস্থা নেব। …বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অপরাধ সংঘঠিত করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।'
সেই সময়ে তিনি শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ ও মামলা তুলে নেওয়ার আশ্বাসও দেন। পাশাপাশি হল খুলে দেওয়াসহ যাবতীয় সমাধানের ব্যাপরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একমত হন।
তবে শিক্ষার্থীরা বলেন, তারা দুই মাস ধরে আন্দোলন করলেও তাদের দাবি মানা হচ্ছে না। তারা এ বিষয়ে আর সময় দিতে চান না। ভিসির পদত্যাগ ছাড়া অনশন ভাঙবেন না বলে জানিয়ে দেন তারা।
সি আর আবরার ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর বুধবার দুপুরে ১০২তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায়স শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও আগে থেকেই এই সাতটি হলের তালা ভেঙে শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করেছিলনে।
কুয়েটের শিক্ষার্থীরা অনশন শুরু করেন গত সোমবার বিকাল ৩টায়। ৩২ জন শিক্ষার্থী অনশন শুরু করেন। তাদের মধ্যে ৫ জন অসুস্থ হয়ে মেডিকেলে ভর্তি হন। এছাড়া দুইজন বাড়িতে চলে যান।
এর আগে গত ১৪ এপ্রিল বিকেলে কুয়েটের ১০১তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওইদিন কুয়েটের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের পাবলিক রিলেশনস অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শাহেদুজ্জামান শেখ জানান, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯৮ তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের দেওয়া প্রতিবেদন সিলগালা অবস্থায় সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হয় এবং সিন্ডিকেট কর্তৃক গ্রহণ করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে ১০ এপ্রিল কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেন নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার হোচেন আলী নামের এক ব্যক্তি। আদালত বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে খানজাহান আলী থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হোচেন আলী কুয়েট রোড দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। পকেট গেটের সামনে গেলে আসামিরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করেন এবং তার সোনার চেইন ছিনিয়ে নেন।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কুয়েট প্রশাসন বাইরের একজনকে উসকানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া ২২ জনের নাম ও পরিচয় এভাবে বাইরের কোনো ব্যক্তির পক্ষে জানা সম্ভব না।
১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটিও করা হয়েছে। ওইদিন রাতেই খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।
২০ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে লাল কার্ড দেখান শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে তারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।