সাভারে একইদিনে দুই চলন্ত বাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ‘অপপ্রচার’ দাবি পুলিশের

সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ব্যাংক টাউন ও সিএন্ডবি এলাকায় একইদিনে পৃথক দুটি চলন্ত বাসে ছিনতাইয়ের অভিযোগকে 'অপপ্রচার' বলে দাবি করেছে পুলিশ।
আজ রোববার (১৩ এপ্রিল) বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) ও ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তার (মিডিয়া) সই বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে অভিযোগ দুটি 'ছিনতাই' হিসেবে উল্লেখ হলেও পুলিশের বিবৃতিতে 'ডাকাতি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে গত ১১ই এপ্রিল (শুক্রবার) সকাল সাড়ে ১১টা ও বেলা ১২টায় আধা ঘণ্টার ব্যবধানে মহাসড়কের পৃথক দুটি স্থানে চলন্ত বাসে অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়।
পরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ১২ এপ্রিল দৈনিক পত্রিকায় ১১ এপ্রিল (শুক্রবার) দুপুর ১২টার দিকে সাভারের বিপিএটিসি এলাকায় এবং ব্যাংক টাউন সিএন্ডবি এলাকায় দুই চলন্ত বাসে ডাকাতি মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
খবর পেয়ে সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘটনার ভুক্তভোগী, সংশ্লিষ্ট বাসচালক, চালকের সহযোগীসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভুক্তভোগী, বাসচালক, চালকের সহযোগীর জবানবন্দি ও অন্যান্য অনুসন্ধানে চলন্ত বাস দুটিতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি মর্মে প্রতীয়মান হয়।
উল্লেখ্য, ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে থানায় কেউ অভিযোগ করেনি।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়েছে- পুলিশ যখন সেবামূলক জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে শতভাগ মনোযোগী হয়েছে, তখনই অপশক্তি পুলিশের মনোবল ভেঙে দিতে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পুলিশবিরোধী অপপ্রচার করছে।
ঘটনার দিন রাজধানী পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৫৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সর্বপ্রথম সিএন্ডবি এলাকার কাছাকাছি নবীনগরগামী রাজধানী পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে তিনজন ছিনতাইকারী চাকু হাতে চালককে বাস থামাতে বলে। তারা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে।
এছাড়াও সাভার পরিবহনের একটি বাসে ছিনতাইয়ের ঘটনার ভুক্তভোগী সাভারের সিনিয়র সাংবাদিক তায়েফুর রহমান অভিযোগ করেন, সেদিন তিনি সাভার পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-০৭০৬) স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার শ্যামলীতে যাচ্ছিলেন। বাসটি ব্যাংক টাউন পার হয়ে পুলিশ টাউন এলাকা সংলগ্ন ব্রিজে ওঠার পর যাত্রীর বেশে বাসে থাকা তিন-চারজন দুর্বৃত্ত ধারালো চাকু হাতে নারী যাত্রীদের জিম্মি করে স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। ছিনতাইকারীরা তার স্ত্রীর গলায় থাকা একটি স্বর্ণের চেইন লুট করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
পুলিশের বিবৃতির বিষয়ে জানতে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) মো. তরিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বিবৃতির বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তবে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে মুঠোফোনে বলেন, 'ঘটনা দুটির কোনো সত্যতা আমরা পাইনি। কোনো অভিযোগও আমরা পাইনি।'
তিনি আরও বলেন, 'যাদের বরাত দিয়ে ঘটনা দুটির সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল—সাংবাদিক তায়েফুর রহমান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস—তাদের সাথেও পুলিশ যোগাযোগ করেছে এবং তারা পুলিশকে জানিয়েছেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।'
ঘটনা না ঘটলে কেন গাবতলীতে একটি বাসকে যাত্রীরা আটক করেছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, 'দারুস সালাম এলাকায় যেই নারী অভিযোগ করেছিলেন, তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।'
ওই নারী 'নাটক' করছিলেন উল্লেখ করে তাকেও পুলিশ নজরদারিতে রেখেছে বলে জানান তিনি।
পুলিশের এই কর্মকর্তা দাবি করেন, 'এটি দুজন সাংবাদিক প্রথমে রিউমার ছড়িয়েছে, পরে সেটির (রিউমার) সাথে অন্যরা তাল মিলিয়েছে।'
কোন দুই সাংবাদিক এমনটা করেছেন জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনের প্রতিনিধি হাফিজ উদ্দিন এবং দৈনিক বাংলাদেশের আলোর প্রতিনিধি সঞ্জিব সাহার নাম বলেন।
এদিকে সেদিনের দুটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া দুজন পরবর্তী সময়ে পুলিশকে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশের এই কর্মকর্তা দাবি করার পর আজ আবারও মুঠোফোনে ওই দুজনের সাথে যোগাযোগ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
তারা উভয়ই নিজেদের সেই দাবি ও অভিযোগের পক্ষে অটল থাকেন।
তায়েফুর রহমান বলেন, 'এমন ঘটনা ঘটেনি'—এ কথা আমি বলব কেন? পুলিশ মিথ্যা বলছে। পুলিশ তো বরাবরই চুরি-ডাকাতি স্বীকারই করেনি। বরাবরের মতো এখনও অস্বীকার করছে যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আমি থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা করিনি ঝামেলা এড়াতে। এগুলো আরেক হয়রানি।'
তিনি জানান, ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ওই এসআই তাকে কয়েকজনের ছবি দেখিয়েছিলেন যে তাদের কাউকে চেনা যায় কি না। কিন্তু ছবি দেখে সাংবাদিক তায়েফুর তাদের কাউকে চিনতে পারেননি। অন্যদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাকে জানিয়েছিলেন বাসের চালক নাকি জানিয়েছেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস আজ টিবিএসকে বলেন, 'আমি তো সেখানে ছিলাম, নিজের চোখে পুরো ঘটনা দেখেছি, তাহলে তারা (পুলিশ) কীভাবে বলে যে আমি মিথ্যা কথা বলেছি? এখানে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?'
তিনি আরও বলেন, 'ঘটনার পর পুলিশের একজন যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছিলেন কী হয়েছে। আমি যা যা ঘটেছে, তাই বলেছি, যা মিডিয়াকে বলেছিলাম।'
"যেহেতু আমার কোনো ক্ষতি হয়নি কিংবা কিছু খোয়া যায়নি, তাই আমি কোনো অভিযোগ করিনি। তাছাড়া এখানে আমার পরিবার থাকে না, লেখাপড়া করতে এসেছি। যার কারণে মামলা-জটিলতায় যেতে চাইনি', যোগ করেন তিনি।
এদিকে কোনো প্রকার তথ্য-প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তার দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সরাসরি 'গুজব' ছড়ানোর অভিযোগের বিষয়টি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন সাংবাদিক হাফিজ উদ্দিন ও সঞ্জিব সাহা।
হাফিজ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমি কীভাবে গুজব ছড়ালাম! আমার রিপোর্ট এসেছে ঘটনার পরদিন ১২ এপ্রিল এবং ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলেই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।'
'আমার বিরুদ্ধে যেহেতু এমন অভিযোগ তিনি করেছেন, আমি বাংলাদেশ পুলিশকে আহ্বান জানাবো বিষয়টি তদন্ত করা হোক। যদি আমি গুজব ছড়িয়ে থাকি তবে আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আর যিনি অভিযোগ করেছেন, তিনি যদি মিথ্যা বলে থাকেন তবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই', যোগ করেন হাফিজ উদ্দিন।
অন্যদিকে সাংবাদিক সঞ্জিব সাহা টিবিএসকে বলেন, 'বিষয়টি দুঃখজনক। আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম এবং সেটি সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বিষয়টি এসেছে। এখানে গুজব কোথায়? পুলিশের পক্ষ থেকে এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার বরং দুঃখজনক।'