ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার: বিশেষজ্ঞরা বলছেন ক্ষতি ভারতের, বাংলাদেশের নয়

বাণিজ্য ও নীতি বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে 'হিতে বিপরীত' হতে পারে।
যদিও প্রাথমিকভাবে এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্যের পথে সম্ভাব্য একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এ সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে—বিশেষ করে রাজস্ব হ্রাস ও আঞ্চলিক ভাবমূর্তির দিক থেকে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রাক্তন সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, 'আমরা মনে করি, এ সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যবসায় খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। বরং ভারত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব হারাবে, কারণ তারা আমাদের পণ্যের জন্য তাদের উদ্বৃত্ত পরিবহন ক্ষমতা বরাদ্দ করেছিল।'
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা)-এর সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, 'শুরুর দিকে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে, কারণ আমাদের উদ্বৃত্ত পণ্য পরিবহন আগে ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহার করে সম্পন্ন হতো।'
তবে তিনি উল্লেখ করেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বাফার সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, 'প্রয়োজনে আমরা অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের জন্য শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারি।'
তিনি আরও বলেন, 'এতে বাংলাদেশ কিছু অতিরিক্ত রাজস্ব ধরে রাখতে পারবে, অন্যদিকে ভারত সে পরিমাণ হারাবে। ভারত সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আমরা জানি না—এটি রাজনৈতিক কারণেও হতে পারে।'
ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। একটি জাপানি কোম্পানি সেখানে স্থল ও কার্গো পরিচালনার দায়িত্ব পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে, যা কার্যকারিতা আরও বাড়াবে।
বাফা সভাপতি আশা প্রকাশ করেন, নতুন টার্মিনালের অবশিষ্ট কাজ চলতি বছরের শেষ নাগাদ শেষ হতে পারে।
বাংলাদেশের বাণিজ্যে বড় ব্যাঘাত ঘটবে না
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্যে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যদিও বাংলাদেশ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ওপর খুব বেশি নির্ভর করে না, তবে মাঝে মাঝে ঢাকা বিমানবন্দরের চাপ কমাতে এ সুবিধা ব্যবহার করা হয়। ফলে এর সম্ভাব্য বাতিল বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত ঘটাবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'বরং এটি ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে কার্গো পরিষেবা চালুর গতি ত্বরান্বিত করতে পারে। যাত্রী পরিষেবা পরবর্তীতে চালু করা যেতে পারে।'
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলেই ভারতকে দেওয়া অন্যান্য ছাড় প্রত্যাহার করা অনুচিত হবে।
তিনি বলেন, 'বিভিন্ন কারণে এ পারস্পরিক ব্যবস্থার ব্যবহার ভারতের দিক থেকে সীমিত ছিল।'
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, ভারতের এ আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেতিবাচক বার্তা দেয় এবং এটি প্রতিবেশীদের মধ্যে সতর্কতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।
তিনি বলেন, এ ধরনের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রসঙ্গে কবির বলেন, 'এটি পারস্পরিক পদক্ষেপের বিষয় নয়। আমরা সুবিধাগুলো পর্যালোচনা করব এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব।'
'ট্রান্সশিপমেন্ট প্রত্যাহার বাণিজ্য-উত্তেজনার প্রতিফলন'
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'এ সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো খাতে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তবে এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত বৃহত্তর ইস্যুটিকে তুলে ধরেছে। এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।'
তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি যত জটিল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এখন আগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং বাণিজ্যের সুষ্ঠু প্রবাহ বজায় রাখা উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।
'ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে অন্যতম, এবং নীতিগত এ পরিবর্তন ভবিষ্যতের উন্নত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সম্ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা আশা করি ভারত তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে এবং উভয় দেশের জন্য উপকারী সমাধান খুঁজে বের করতে সংলাপে বসবে,' বলেন সেলিম রায়হান।
তিনি আরও বলেন, 'দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, এবং এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুই দেশের যৌথ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়।'